আরব উপদ্বীপের প্রায় সব অংশ পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণ জলবায়ুর অন্তর্ভুক্ত। তবে গবেষকরা মনে করেন, অতীতে এমনটি ছিল না। উত্তর আফ্রিকা এবং আরব উপদ্বীপের বিস্তীর্ণ মরুভূমির বেশিরভাগ অংশ একসময় সবুজে ঢাকা ছিল। প্রকৃতপক্ষে, সাম্প্রতিক গবেষণা ইঙ্গিত করে যে এটি একসময় সবুজ এলাকা ছিল যা আফ্রিকা থেকে চলে আসা আদিম মানুষের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ধরা হয়।
প্রায় ১১,৭০০ বছর আগে শুরু হওয়া হোলোসিনের সময় আরব উপদ্বীপের জলবায়ু ছিল অধিক বৃষ্টিপাতযুক্ত এবং আর্দ্র। এটি গাছপালা বিকাশ এবং মানব বসতির ইঙ্গিত দেয়। এই সময়কে ‘সবুজ আরব’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, এবং এটি প্রায় ৪,৫০০ থেকে ২,০০০ বছর আগপর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
আরব উপদ্বীপ যে তেলের বিশাল ভাণ্ডার তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তেল হলো মৃত মাইক্রোস্কোপিক উদ্ভিদ এবং প্রাণীর দেহাবশেষ, যারা লক্ষ লক্ষ বছর আগে মহাসাগর, নদী বা হ্রদে বাস করতো। অক্সিজেনের অভাব মৃত অণুজীবগুলো এসব হাইড্রোকার্বনে পরিণত হয়। আরব উপদ্বীপের দেশগুলোতে বিলিয়ন বিলিয়ন ব্যারেল তেল মজুদ রয়েছে।
এই ধরনের বিশাল তেলক্ষেত্র থাকার অর্থ হলো লক্ষ লক্ষ বছর ধরে, এমনকি শেষ বরফ যুগ শুরু হওয়ার আগে, আরব উপদ্বীপটি আজকের মতো শুষ্ক অনুর্বর ভূমি ছিল না; বরং হ্রদ এবং নদী অববাহিকার স্বর্গ ছিল। আর সেখানে বিচরণ করতো বহু প্রাণী।
প্রায় ৬,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে নীলনদের উপত্যকার ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে যেসব মানব সম্প্রদায় বাস করতো, একপর্যায়ে তাদের অনেকেই এশিয়ায় চলে আসে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, মূলত শুষ্ক মরুভূমির আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে এই সম্প্রদায়গুলো আরবে আসতে আকৃষ্ট হয়।
বর্তমানে আরব উপদ্বীপের বেশিরভাগ অংশ বালুকাময়, শুষ্ক এবং জনশূন্য হলেও এটি একসময় সবুজে ঢাকা ছিল। বিজ্ঞানীরা সাম্প্রতিক দশকগুলোতে এরকম কিছু প্রমাণই সংগ্রহ করছেন। অতীতের আরব ছিল আর্দ্র আবহাওয়াসমৃদ্ধ, যেখানে পূর্ব আফ্রিকার সাভানার মতো পরিবেশ ছিল। বর্ষাকাল এবং গাছপালা বৃদ্ধির কারণে মৌসুমী বায়ু উত্তর দিকে সরে যায় এবং এই অঞ্চল আর্দ্র হয়ে ওঠে।
মানববসতির অবশিষ্টাংশ ‘সবুজ আরব’ যুগের অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়। এই সময়ে, বর্তমান শুষ্ক জলবায়ুর কারণে বসবাসের অনুপযোগী এলাকায় বৃহৎ জনবসতি গড়ে ওঠে। এই বসতিগুলো প্রায়শই শুকনো নদীর তলদেশের কাছাকাছি অবস্থিত ছিল, যা বর্ষাকালে জলে ভরা থাকতো। এই বসতিগুলোর অবশিষ্টাংশগুলোর মধ্যে রয়েছে স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য, যেমন- বাড়ি ও সমাধি, সেই সাথে মৃৎশিল্প ও পাথরের হাতিয়ারের মতো শিল্পকর্ম।
সৌদি প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কিত একটি সাম্প্রতিক কনভেনশনে সৌদি আরবের বিভিন্ন অংশে গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক কিছু আবিষ্কার প্রকাশিত হওয়ার পর সৌদি আরব ও উপসাগরীয় অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে বিশ্বের ধারণা পাল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কনভেনশনের আয়োজক সৌদি কমিশন ফর ট্যুরিজম অ্যান্ড এন্টিকুইটিস ন্যাশনাল হেরিটেজের (এসসিটিএইচ) ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. আলী আল গাব্বান বলেন, “এই আবিষ্কার ইঙ্গিত দেয় যে আরব উপদ্বীপ একসময় একটি সবুজ জায়গা ছিল, বিশেষ করে আজকের মরুভূমি অঞ্চলগুলো।“
উত্তর সৌদি আরবের তাইমা প্রদেশের একটি শুকনো হ্রদের তলদেশে ৩,৫০,০০০ বছরের পুরনো একটি হাতির দাঁত পাওয়া গেছে। এছাড়া, প্রত্নতাত্ত্বিকরা এখানে কুমির ও সামুদ্রিক ঘোড়ার মতো অন্যান্য প্রাণী ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর জীবাশ্ম আবিষ্কার করেছেন যা শুষ্ক জলবায়ুতে বেঁচে থাকতে পারতো না। এছাড়াও গবেষক এবং বিজ্ঞানীরা আরব উপদ্বীপ জুড়ে ১০,০০০টি প্রাচীন হ্রদ এবং নদী আবিষ্কার করেছেন। এছাড়া ৯০ হাজার বছরের পুরনো মানুষের হাড় এবং পাথরের সরঞ্জামও হ্রদের কাছে পাওয়া গেছে।
এক দশক আগ পর্যন্ত, আরব উপদ্বীপটি বিজ্ঞানীদের জন্য তেমন কোনো আকর্ষণের স্থান ছিল না। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রাথমিক বিবর্তন ও আফ্রিকার বাইরে তাদের ছড়িয়ে পড়ার ইতিহাস এবং লেভান্ট অঞ্চলে প্রাথমিক মানববসতি সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানা যায়।
আরব উপসাগরের একটি সুপরিচিত প্রত্নতাত্ত্বিক রেকর্ড রয়েছে, যা ১০,০০০ বছর পুরনো। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে জনসংখ্যাকে প্রভাবিত করেছে, কীভাবে সমাজের মানুষেরা শিকারী-সংগ্রাহক থেকে পশু-শিকারী এবং জেলেদের মধ্যে পরিবর্তিত হয়েছে তা পরীক্ষা করে আরও ভালভাবে বোঝা দরকার।
এছাড়া আরব উপসাগরের গভীরে এমন নিদর্শন রয়েছে, যা ১,০০,০০০ বছর বা তারও বেশি আগের গোপন ইতিহাসকে বহন করতে পারে। এজন্য এই অঞ্চলে বিস্তারিত প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ এবং খনন অত্যন্ত প্রয়োজন।
উত্তর-পশ্চিম সৌদি আরবের প্রাগৈতিহাসিক কালে প্রাপ্ত পাথরের উপর চিত্রিত প্রাণীর ছবির উপর নতুন গবেষণায় দেখা গেছে এখানে একসময় সেসব প্রাণী ও মানুষরা বিচরণ করত, এবং তারা জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাবিত হয়।
২০১৩ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং সৌদি কমিশন ফর ট্যুরিজম অ্যান্ড ন্যাশনাল হেরিটেজের সহযোগিতায় প্যালিওডেজার্টস প্রজেক্টের গবেষকরা প্রাণীদের ছবিসহ ২৫৪টি পাথরে খোদাই করা চিত্রশিল্পের একটি অংশ খুঁজে পেয়েছেন।
গ্রেট নাফুদ মরুভূমির জাবাল উম্ম সানমানে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ হ্রদের তীরে পাথরে খোদাই করা চিত্রশিল্প, এপিগ্রাফি এবং মানুষের বসবাসের প্রমাণ মিলেছে, যার বয়স প্রায় ৮,০০০ বছর। এটি বর্তমানে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য বিবেচনাধীন রয়েছে।
প্রায় ১১,০০০ থেকে ৬,০০০ বছর আগে আর্দ্র আবহাওয়ার শেষ পর্যায়টি ছিল বলে ধারণা করা হয়। এরপর আরব তার বর্তমান শুষ্ক অবস্থায় ফিরে আসে এবং মরুভূমিতে পরিণত হয়। প্রায় ৫,০০০ বছর আগে আরব অঞ্চল শুকিয়ে যেতে শুরু করে।
কিন্তু আরবের লোকেরা খুব চালাক ছিল; তারা চমকপ্রদ এবং উদ্ভাবনী কাজ করেছে। তারা গৃহপালিত প্রাণী, এমনকি উদ্ভিদকেও তাদের অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করে, এবং ভূগর্ভস্থ কূপ খনন করতে শুরু করে, যা তাদের খরার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকার আশা দেখায়।
বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবী অক্ষের ২৪.১ ডিগ্রি থেকে বর্তমান ২৩.৫ ডিগ্রিতে পরিবর্তনের কারণে মৌসুমী বৃষ্টিপাত পিছিয়ে গেছে, যা এই অঞ্চলের ভূমিকে সরাসরি সূর্যের আলোর সংস্পর্শে এনেছে। বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে জলবায়ুর পরিবর্তন এই মরুভূমিকে আবারও সবুজ করে তুলতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে, সবুজ আরবের চক্রাকার প্রকৃতির অর্থ হলো ভবিষ্যতে কোনো না কোনো সময় এই অঞ্চলটি আবার জমকালো এবং গাছপালায় পূর্ণ হয়ে উঠবে, যদিও গবেষকরা নিশ্চিত নন যে এটি কখন ঘটতে পারে এবং সাধারণভাবে জলবায়ু পরিবর্তন সবুজায়ন সৃষ্টিতে বাধা দেবে কিনা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৪৫
আপনার মতামত জানানঃ