অনেক অনেক দিন ধরেই ইতিহাবিদ এবং নৃতত্ত্ববিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল দশ থেকে পনের হাজার বছর আগে বর্তমান তুরস্ক থেকে ইরাক পর্যন্ত বিস্তৃত নদীবিধৌত উর্বর উপত্যকায় মানুষ প্রথম কৃষিকাজ শুরু করে। যাযাবর শিকারির জীবন ত্যাগ করে ডেরা বাধায় মন দেয়, অনেক সাধনা করে বুনো উদ্ভিদ এবং পশুকে পোষ মানিয়ে নিজের প্রয়োজন মেটাবার তাগিদে পুনঃপ্রজননে সক্ষম হয়। এই ছোট ছোট মানবগোত্র থেকেই একসময় পত্তন ঘটে নগর সভ্যতার, আসে রাষ্ট্র, আসে ধর্ম, আসে অন্ধ বিশ্বাস, আসে লিখন পদ্ধতি, চিত্রকলা।
যদিও আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে আসা যাযাবর গোষ্ঠীরও হয়ত নিজস্ব বিশ্বাস ছিল, তারা প্রকৃতির নানা দৃশ্য-অদৃশ্য বস্তু, শক্তি ইত্যাদিকে দেবতা হিসেবে আরাধনা করত, কিন্তু মানুষের বিশ্বাস যে আদি সমাজ গঠনে সহায়ক ছিল এমন ধারণা ছিল প্রশ্নেরও অতীত। কিন্তু প্রচলিত সব ধারণাকে গুঁড়িয়ে সত্যের আলোকে উদ্ভাসিত করেছে গোবেকলে তেপে।
গোবেকলি তেপে (Gobekli Tepe) নিওলিথিক যুগের মানুষদের তৈরি এক বিশাল স্থাপনা, আসলে এটি মানুষের বসবাসের জন্য নির্মিত কুঁড়েঘরের বাহিরে তৈরি প্রথম স্থাপত্যকলার নিদর্শন। নির্মিত হয় ১২,০০০ বছর আগে! এর অবস্থান বর্তমান দক্ষিণ তুরস্কে।
আমাদের প্রাপ্ত প্রমাণ সাপেক্ষে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন উপাসনালয়। নিওলিথিক যুগের শিকারি, পশুপালক এবং নব্য কৃষকেরা এখানে আসতেন তাদের মনে গজিয়ে ওঠা ঈশ্বরদের নৈবদ্য দিয়ে পরের বছরের সুখাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে। একটা ধারণা হচ্ছে, দেবতাদের সাথে সাথে মৃতদের কল্পিত আবাস হিসেবেও হয়ত এটি ব্যবহৃত হত। বৃটেনের স্টোন হেঞ্জের চেয়ে এটি দ্বিগুণ পুরনো।
এখন পর্যন্ত বিশাল মন্দিরটির মাত্র ১০ ভাগ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, এবং বোঝা যাচ্ছে এখানে হয়ত স্থায়ীভাবে মানুষ বসবাস করত না কখনোই, কেবল মাত্র বছরের নির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন গোত্রের মানুষ আলাদা আলাদা ভাবে এসে একসাথে অর্পণ করত তাদের উপহার। সেই হিসেবে বিশ্বের প্রথম উপাসনালয়ের সাথে সাথে প্রথম তীর্থও গোবেকলে তেপেই। এইখানেই জন্ম নিয়েছিল আদি ধর্মের, যা পরবর্তীতে মানব বসতি বিস্তারের সাথে সাথে নানা রূপে নানা গল্পে ছড়িয়ে গেছে সারা গ্রহে এবং এখনো ছড়াচ্ছে।
অর্থাৎ ধর্ম এসেছে মাত্র ১২ হাজার বছর আগে। অথচ প্রায় ৭ লক্ষ ৯০ হাজার বছর আগে হোমো হাইডেলবার্গেনসিসরা আগুন জ্বালানোর জন্য চুলা ব্যবহার করেছিল। আমরা ইসরায়েলের গেশের বেনোট ইয়া-আকভ নামক স্থানে সেই সময়কার আগুনে বিকৃত টুলস, পোড়া কাঠের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছি। এই আদিম ওভেনের পাশে তারা সবাই একত্রিত হয়েছিল।
সম্ভবত তারা দলবদ্ধ হয়েছিল সামাজিকতা, বিশ্রাম, খাবার, তথ্য আদান-প্রদান করার জন্য এবং শিকারি প্রাণী থেকে নিরাপদ থাকার জন্য। হোমো হাইডেলবার্গেনসিস সম্ভবত ন্যাচারাল শেল্টারেই অবস্থান করেছিল কিন্তু তারাই প্রথম সরল বাড়ি নির্মাণ করেছিল যার প্রমাণ আমরা পেয়েছিলাম টেরা, অ্যামাটা ফ্র্যান্সে।
৪০০ হাজার বছর আগের আদি বাড়ির নকশার একটি কাল্পনিক পুনর্গঠন যে নকশা আমরা ফ্র্যান্সে পেয়েছিলাম। আমরা এখনো স্যাপি শিশুদের মধ্যে ঘর তৈরির করার প্রবণতা দেখি। এই প্রবণতা কি তবে আমাদের বিবর্তনীয় অতীতেরই একটি প্রতিফলন?
যাইহোক, হোমো হাইডেলবার্গেনসিসরাও মানুষই ছিল। আর আমরা হোমো স্যাপিয়েন্স তাদের মস্তিষ্কের অ্যানসেস্ট্রাল সার্কিট বহন করছি কিন্তু তাদের মধ্যে যে জিনিসটা ছিল না তা হলো ধর্ম এবং নারী-পুরুষের বৈষম্য।
কিন্তু ধর্ম-ঈশ্বর ও লিঙ্গ বৈষ্যমের অনুপস্থিতি তাদের জীবনে কোনো প্রভাব ফেলেনি। হোমো বোডোয়েনসিসেরও ধর্ম ছিল না, ছিল না নারীবাদ অথবা পুরুষতন্ত্র। কিন্তু তারা টিকে ছিল।
সার্ভাইভালের জন্য ঈশ্বর, ধর্ম অথবা কোনো ইজমের প্রয়োজন নেই তার সাপেক্ষে এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে? ধর্মহীন আর্ডিওপিথিকাস ১২ লাখ বছর টিকে ছিল। ধর্ম ও ঈশ্বরহীন অস্ট্রোলোপিথিকাস ৭-৯ লক্ষ বছর টিকে ছিল। ঈশ্বরহীন হোমো ইরেক্টাস ২০ লক্ষ বছর টিকে ছিল।
শুধু তাই নয়, এই সকল ধর্মহীন মানুষের জিনই আমাদের আজকের মানব সভ্যতা বহন করছে, যারা বিবর্তিত হয়েছিল মাত্র এক লাখ বছর আগে এবং তারা আগামী ৫০০ বছরও সার্ভাইভ করতে পারবে কি না তার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না কোনো বিশেষজ্ঞ!
কিন্তু তারা মনে করছে তাদের জন্য ধর্ম খুবই প্রয়োজন, ধর্ম ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব হয় না! প্রশ্ন হলো, অস্ট্রোলোপিথিকাস, হোমো হ্যাবিলিস, হোমো ইরেক্টাস, হোমো হাইডেলবার্গেনসিস, হোমো অ্যান্টিসেসর, হোমো বোডোয়েনসিস এরা সবাই কি তবে অমানুষ ছিল?
মাত্র ১ লক্ষ বছর হলো আপনি এসেছেন, আপনি উলঙ্গ হোমো ইরেক্টাসদের ২০ লক্ষ বছরের রেকর্ডও এখনো ভাঙতে পারেননি।
আপনি বুদ্ধিহীন আনস্ম্যার্ট অস্ট্রোলোপিথিকাসদের ৮ লক্ষ বছরের রেকর্ডও এখনো ভাঙতে পারেননি। আপনার ধর্ম ও ঈশ্বর আপনাকে স্পেশালি কি দিয়েছে আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারবেন? আমি বলছি না যে, ঈশ্বর ও ধর্মের বিবর্তনীয় ব্যাখ্যা নেই।
আজকের সমাজে নগ্ন হলে তার ছবি ভাইরাল হয়। কোনো একজন নায়িকার পোশাক একটু তারতম্য হলে তাকে নিয়ে আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সবাই ট্রল করে ও মজা নেয়! মানুষের কাছে আজ নগ্নতার মতো একটি স্বাভাবিক ব্যাপার অনেক বেশি অস্বাভাবিক ও বিকৃত।
হোমো ইরেক্টাসরা ২০ লাখ বছর নগ্ন ছিল, মানুষের সরাসরি পূর্বসূরি হোমো অ্যান্টিসেসর নগ্ন ছিল, তাদের কাছে এটার কোনো আলাদা বিশেষত্ব ছিল না, এটা অত্যন্ত তুচ্ছ একটি ব্যাপার ছিল। এমন তো নয় যে, তারা নিরবিচ্ছিন্নভাবে শুধু সেক্সই করেছে? যেখানে টিকে থাকাটাই ছিল ব্যাপক সংগ্রামের সেখানে শরীর পর্যবেক্ষন অথবা ইভটিজিং করে সময় নষ্ট করার অবকাশ কোথায়?
আজ যদি সমস্ত পৃথিবী একযোগে নগ্ন হয়ে যায় কিছুই হবে না। খোলা মাঠে সবাইকে প্যান্ট-শার্ট খুলে ছেড়ে দিন, দেখবেন সবকিছু আগের মতোই আছে, উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো পরিবর্তনই হয়নি।
হোমো ইরেক্টাসদের চারপাশে শত শত নারী নগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিল। হোমো স্যাপিয়েন্স যারা নিজেদের এতটা উন্নত মনে করছে তারা সামান্য একটা যৌনতার সংস্কার থেকেই ঠিকভাবে বেরিয়ে আসতে পারছে না, এটা খুবই অদ্ভুত একটি বিষয়!
[সংকলিত, মূল লেখক: অ্যান্ড্রোস লিহন ]
আপনার মতামত জানানঃ