বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া, সার্বিয়া, মন্টিনেগ্রো, বসনিয়া, রোমানিয়াসহ বেশ কিছু দেশ নিয়ে দক্ষিণ ইউরোপের বলকান অঞ্চল গঠিত। প্রাচীন আমল থেকেই এ অঞ্চলে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগে থাকে। অটোমান শাসনামলে তুর্কিরা বলকান অঞ্চলের অনেকটা অংশ নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। আলবেনিয়া এ সময়ে তুর্কি শাসনের অধীনে ছিল।
অটোমান সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, মন্টিনেগ্রো আর গ্রিস বলকান অঞ্চলে তুর্কিদেরকে যুদ্ধে পরাস্ত করে। এ ডামাডোলের মধ্যে আলবেনীয় নেতা ইসমাইল কেমালি স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসেন। নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ১৯২৫ সালে আলবেনীয় প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়। তবে তিন বছর পরেই ক্ষমতা চলে যায় রাজপরিবারের হাতে। রাজা জগু রক্ষণশীল শাসনে মুড়ে ফেলেন ছোট্ট দেশটিকে।
১৯৩৯ সালে মুসোলিনির ইতালি আচমকা আলবেনিয়া আক্রমণ করে দখল করে ফেলে। ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত জার্মান আর ইতালীয় কর্মকর্তারা আলবেনিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। এই দখলদারিত্বের মধ্যেই দেশটির কম্যুনিস্টরা গড়ে তোলে ‘আলবেনিয়ান ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি’।
প্রায় লক্ষাধিক গেরিলা এই বাহিনীর হয়ে ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৯৪৪ সালের নভেম্বরে আলবেনিয়া মুক্ত হয়। পরে যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধেও আলবেনিয়া সৈন্য পাঠায়। রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয় এবং এনভার হোক্সার নেতৃত্বে ১৯৪৬ সালে পিপলস রিপাবলিক অব আলবেনিয়া নামের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। হোক্সা হয়ে যান দেশের সবথেকে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি।
উল্লেখ্য, অন্য অনেক দেশের নেতারা যেমন প্রথমে কঠোর থেকে পরবর্তী আমলে নরম হন, হোক্সার শাসনামল ছিল ঠিক তার উলটো। উদার নেতা থেকে আশির দশকে তিনি পরিণত হন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিঃসঙ্গ, কঠোর এক নেতায়, যার নতুন নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা প্রায়ই ছোট্ট দেশটির সাধ্যে কুলাতো না। তবে তার আমলের অন্যান্য ঝানু নেতাদের তুলনায় হোক্সাকে ভাগ্যবানই বলতে হবে। ১৯৮৫ সালেই মারা যাওয়ায় তাকে দেখে যেতে হয়নি সমাজতন্ত্রের পতনের পর কীভাবে বিক্ষুব্ধ জনতা তিরানায় তার মূর্তি ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলছে। হোক্সা অনেক বই লিখে গিয়েছেন।
এবার আসা যাক আলবেনিয়ার নাস্তিক দেশ হয়ে ওঠা প্রসঙ্গে। ১৯৭৬ সালে ইউরোপীয় দেশ আলবেনিয়াকে সরকারিভাবে নাস্তিক দেশ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এনভার হোক্সা মার্ক্সের সাথে একমত হয়েছিলেন যে ধর্ম একটি আফিম, পুরো দেশকে নষ্ট করে দিচ্ছে। একমাত্র মুসলিম দেশ, যা পরিচিতি পেল নাস্তিক দেশ হিসেবে। প্রকৃতপক্ষে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আলবেনিয়ায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে।
ভয়ঙ্কর যুদ্ধের পর যেখানে অন্যান্য দেশগুলো অর্থনৈতিক সঙ্কটের সাথে লড়াই করছিল এবং তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতিতে নিয়োজিত ছিল, তখন আলবেনিয়ায় ধর্মকে শেষ করার জন্য প্রচারণা চালানো হয়েছিল। এখানে ব্যাপকভাবে ধর্মীয় স্থান ভাঙার কাজ শুরু হয়। এ সময় ১৯৭৬ সালে, আলবেনিয়াকে বিশ্বের প্রথম নাস্তিক দেশ (প্রথম নাস্তিক দেশ) ঘোষণা করা হয়।
উল্লেখ্য, ২,১৮৯টি মসজিদ এবং চার্চ বন্ধ করে দেওয়া হয়। নাস্তিকবাদ অফিসিয়াল পলিসিতে পরিনত হয়। ধর্মীয় নামের শহর, নগরগুলোকে নতুন নাম দেয়া হয়, ব্যক্তির নামও বদলে ফেলা হয়। ১৯৮২ মানুষের নামের ডিকশনারি বের করা হয়। যার মধ্যে ৩,০০০ সেক্যুলার নাম ছিল।
১৯৭৬ সালে যখন আলবেনিয়াকে নাস্তিক দেশ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন দেশটিতে মুসলিম জনসংখ্যা বেশি ছিল। কিন্তু কমিউনিস্ট স্বৈরশাসক আনোয়ার হোক্সা দেশকে নাস্তিক দেশে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নেন।
স্বৈরশাসক এনভার হোক্সা কমিউনিস্ট দার্শনিক কার্ল মার্কসের দ্বারা বেশি প্রভাবিত ছিলেন। স্বৈরশাসক আনোয়ার হোজা ধর্মকে আফিম মনে করতেন এবং বলতেন ধর্মের কারণে পৃথিবী ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যেতে পারে। সেখানেও লেবার পার্টি তাদের স্লোগান করে এবং আলবেনিয়াকে নাস্তিক দেশ ঘোষণা করে।
নিষেধাজ্ঞার সাথে সাথে দেশে যে কোনও ধরণের ধর্মীয় অনুশীলন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়েছিল। যদি কোনও ব্যক্তি তার ধর্মে বিশ্বাসী হন, কোনও ধরণের ধর্মীয় বই পড়েন বা কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন বা উপস্থিত হন, তবে তিনি কঠোর শাস্তি পান। হোখা বলেছিলেন যে ধর্মের পরিবর্তে লোকেরা তাকে ও দলকে সম্মান করবে। এ কারণে প্রথম নাস্তিক দেশে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে খারাপভাবে চূর্ণ করা হয়েছিল।
আলবেনিয়াকে নাস্তিক দেশ বানানোর প্রচারণার সময় দুই হাজারেরও বেশি উপাসনালয় হয় ধ্বংস বা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই মাজারগুলিতে মসজিদের সাথে গীর্জাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিপুল সংখ্যক লোকের সাথে সামরিক বিচার পরিচালিত হয়েছিল এবং তারপর তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
ওই সময়ে অনেকে ধর্মের বিরুদ্ধে চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং লোকদের দেখানোর জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন যাতে তাদের মন পরিবর্তন হয়। সেই সময়ে এ জাতীয় অনেকগুলি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল, যা ফ্রিডম বা ডেথ অ্যান্ড ডু টু ডু ওয়ান’র পায়ে ধর্মের দ্বারা সৃষ্ট মন্দগুলি সম্পর্কে কথা বলেছিল।
এই ছবিগুলিতে বলা হয়েছিল যে পাশ্চাত্য দেশগুলির সাথে একাত্ম হয়ে ধর্ম গুরুরা তাদের নিজের দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছিল। আলবেনিয়ায় কেবল একটি চ্যানেল ছিল, এটি অফিসিয়াল ছিল।
এতে, এই জাতীয় চলচ্চিত্রগুলি প্রায় প্রতিদিন প্রদর্শিত হয় যাতে প্রত্যেকে সেগুলি দেখতে পারে। এখনও, এই সিনেমাগুলি বেসরকারী টিভি চ্যানেলগুলিতেও আসতে থাকে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, আলবেনিয়ার সংবিধানে দেশটিকে নাস্তিক হওয়ার কথা বলা আছে। আলবেনিয়ার সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে রাষ্ট্র কোন ধর্মকে স্বীকৃতি দেয় না। বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা প্রচার করতে নাস্তিকতাকে সমর্থন করে। এ ছাড়া সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদে দেশের অভ্যন্তরে ধর্মীয় ভিত্তিতে যে কোনো প্রতিষ্ঠান গঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
এসডব্লিউএসএস/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ