নর্স মিথলজিতে দেবতা ‘ওডিন’ কিংবা লর্ড অব দ্যা রিংসের ‘সারুমান’, এদের মতো দুর্ধর্ষ রকমের প্রতাপশালী চরিত্রদেরও সময়ে সময়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা অপারেশন চালিয়ে তথ্য বের করে আনতে নির্ভরশীল হতে হয়েছিলো ‘কাক’ প্রজাতির সদস্যদের উপরে। হয়তো নর্স পুরাণের এমন কোনো গল্প পড়েই ১৯৬০-এর দশকে সিআইএ-র মাথায় এসেছিলো, কাকদের সিআইএ এজেন্ট বানানোর পরিকল্পনা।
তখন চলছিলো আমেরিকা-রাশিয়া স্নায়ুযুদ্ধ। একজন আরেকজনের থেকে রাজনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগত ভাবে এগিয়ে থাকার যুদ্ধ। এর জন্যে যা করা প্রয়োজন তাই করা হবে, তা যতই উদ্ভট হোক না কেন। ফলে কে কাকে টেক্কা দিবে–এই প্রশ্নে যখন কাকের আবির্ভাব ঘটলো, তখন সেটাকে লুফে নেয়া হলো।
সিআইএ এর আগে অবশ্য ‘একোস্টিক বিড়াল’ নিয়েও কাজ চালিয়েছিলো। বিড়ালের শরীরে লিসেনিং ডিভাইস বসিয়ে সেটাকে পর্যাপ্ত ট্রেনিং দিয়ে ছেড়ে দেয়া, যাতে কোনো গোপন মিটিংস্থলে গিয়ে বসে চুপচাপ জিভ দিয়ে নিজের পা চাটতে চাটতে সবার কথা শুনে যেতে পারে।
যাই হোক, সিআইএর পক্ষ থেকে ডাকা হলো হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির দুই অ্যানিমেল সাইকোলজিস্টকে–বি এফ স্কিনার এবং বব বেইলি। দুইজনেই এনিমেল বিহেভিয়ারিস্ট। এর মধ্যে স্কিনারের এই লাইনে ক্যারিয়ার বেশ সমৃদ্ধ। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ‘পিজন মিসাইল’ প্রজেক্টের তত্ত্বাবধানে ছিলেন!
তিনি এমন এক প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছিলেন, যেটায় কবুতরেরা একটা মিসাইলকে উড়িয়ে নিয়ে যায় লক্ষ্যবস্তু বরাবর। সাধারণ মিসাইলে যেকোনো কারণেই সিগন্যাল জ্যামিং ঘটতে পারে। কিন্তু ‘কবুতর ক্ষেপণাস্ত্র’-তে এই সমস্যা নেই। কবুতরেরা মিসাইলের ভিতরে খোপের মধ্যে বসে স্ক্রিনে ঠোঁট ঠুকে ঠুকে একটা পয়েন্টারকে (যেটা মূলত মিসাইলের লক্ষ্যবস্তু) কেন্দ্রে রাখার চেষ্টা করে। বিনিময়ে তাদের শস্যদানা খেতে দেয়া হয়। ঐ ক’টা দানার লোভেই “শান্তির প্রতীক” নামধারী কবুতরেরা এমন ভয়াবহ ক্যারিয়ার বাছাই করেছিলো (বা তাদের বাধ্য করা হয়েছিলো বাছাই করতে)।
তবে এই প্রজেক্ট বেশিদূর আগানো যায়নি। কারণ ট্রেনিং প্রাপ্ত কবুতরেরা মারা যেতো। আর প্রতিটা মিসাইলের জন্যে এতো বেশি সংখ্যক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কবুতর যোগান দেয়াও সম্ভব ছিলো না।
সে যাই হোক, ২য় বিশ্বযুদ্ধের কবুতরদের ছেড়ে ফিরে আসি স্নায়ু যুদ্ধকালীন কাকদের কথায়। এই দুই বিশেষজ্ঞ মিলে কাকদের ট্রেনিং দিলেন। তাদের শেখালেন –কী করে একটা লিসেনিং ডিভাইস বহন করে সেটা কোনো রুমের জানালার চিপায় রেখে আসতে হয়, কী করে জানালার শার্সিতে একটা বিশেষ ধরণের ক্যামেরা ঠোকর মেরে সেটাতে রুমের ভিতরের পরিষ্কার ফটো তুলতে হয় ইত্যাদি।
এই সব কাককে এছাড়াও শিখানো হয়েছিলো কী করে শত্রুপক্ষ কোথাও ওঁত পেতে বসে থাকলে সেটার তথ্য পৌঁছাতে হয়। ধরা যাক শত্রুপক্ষের কোনো স্নাইপার ঝোপের ভিতরে বসে আছে। স্পাই কাকটা একটা ডিভাইস বহন করে নিয়ে উড়তে থাকলো। উড়তে উড়তে সে দেখলো একটা মানুষ ঝোপের ভিতরে বসে আছে। কাকটা তার প্রশিক্ষণ অনুযায়ী উড়ে গিয়ে বসে পড়লো সেই ঝোপের পাশের কোনো গাছের মগডালে। কাকটা যতক্ষণ উড়ছিলো, ততক্ষণ তার অবস্থান রাডারে সিগন্যাল হিসাবে ভেসে আসছিলো। সে বসে পড়তেই সিগন্যাল বন্ধ হয়ে গেলো, আর শত্রুর অবস্থান মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেলো।
১৯৭০-এর দশকে এই প্রজেক্টটা বন্ধ করে দেয়া হয়। মনে হয় কাক নিয়ে সিআইএর সব ফ্যান্টাসি উড়ে গিয়েছিলো ঐসময়। তবে বব বেইলি দাবী করেন বেশ কয়বার নাকি স্পাই কাক ব্যবহার করা হয়েছিলো বিভিন্ন গোপন মিশনে।
বেইলির মতে, কবুতরেরা আসলে তেমন চালাক নয়। পেঁচারাও তেমন স্মার্ট নয়। বিভিন্ন জনপ্রিয় সাহিত্যে পেঁচাদের জ্ঞানী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তারা জ্ঞানী কিনা জানা নেই, তবে তারা চালাক-চতুর নয়। কিন্তু কাক হচ্ছে পক্ষীকুলের মধ্যে প্রতিভাধর এক প্রজাতি। তারা ভীষণ ধূর্ত। এর সাথে আছে তাদের বেসিক কিছু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দক্ষতা, যেটা ঐ প্রোগ্রামে বেশ প্রয়োজন ছিলো।
বেইলি আরো বলেন, কাকেরা পুরো একা একটা মিশন পরিচালনা করতে সক্ষম। এরা অন্যান্য পাখিদের তুলনায় অতিরিক্ত ভারও বহন করতে পারে। পশ্চিমা কাকেরা (Western Raven) প্যাটার্ন বুঝতে সক্ষম। তারা বুঝতে পারে বড় ডেস্ক এবং ছোট ডেস্কের পার্থক্য। সঠিকভাবে ট্রেনিং দিলে তাদের দিয়ে কেবিনেটের ড্রয়ার খুলে ফাইলও বের করে নিয়ে আসা সম্ভব।
এসডব্লিউএসএস/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ