রাত পেরিয়ে শহরে সবে ভোর হচ্ছে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে সবাই তখন অঘোর ঘুমে। আর এরা যেন সেই শান্তির ঘুমে ব্যাঘাতকারী। কখনো জানালায় টোকা মেরে, কখনো দরজায় ধাক্কা দিয়ে, কখনো বা সাইরেন বাজিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে চলেছেন। চোখ কচলাতে কচলাতে কেউ আবার জানালা দিয়ে গালিগালাজও করে দিলেন। কিন্তু তাতে কী। এটাই তো তাদের কাজ। হ্যাঁ, তখনো বিদ্যুৎ, প্রযুক্তি, অ্যালার্ম ঘড়ি এতটা সহজলভ্য হয়নি। অনেক জায়গায় মানুষজনের ধরাছোঁয়ারই বাইরে ছিল।
সেই সময় অর্থাৎ বিংশ শতকের শুরুর দিকে ঘুম ভাঙানোর জন্য নিযুক্ত করা হতো লোকজনকে। তাদের বলা হতো নকার আপ বা নকার আপার্স। ব্রিটেনে কিছু মানুষকে এমন চাকরিতে রাখা হতো। চলুন সেই যুগের মানব ঘড়ির ইতিহাসটা জেনে নেওয়া যাক।
শিল্প বিপ্লবের সময় নকার-আপার ছিল ১৮ শতকের মাঝামাঝি থেকে ১৯ শতকের মাঝামাঝি শতকের একটি পেশা যখন অ্যালার্ম ঘড়ি জনপ্রিয় ছিল না এবং সেগুলি সস্তা বা নির্ভরযোগ্যও ছিল না। ব্রিটেনের কারখানার শ্রমিকদের সেসময় অ্যালার্ম ঘড়ি ক্রয় করা ছিলো দুঃসাধ্য ব্যপার। যেহেতু সেসময়টায় শিল্পায়ন ক্রমবর্ধমান ছিলো তাই কল-কারখানাগুলি আরও বেশি শ্রমিক এবং আরও বেশি ওয়ার্কিং আওয়ারের প্রয়োজন অনুভব করে।
সেসময় শ্রমিকরা খুবই ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করত এবং কাজে যোগ দেয়ার সময়ের ব্যাপারে কল-কারখানাগুলো কঠিন ছিল। দেরি করলে চাকরি চলে যাওয়া কিংবা মাইনে থেকে বেতন কেটে নেয়ার ভয় ছিল, এমনিতেই ছিল অল্প বেতনের চাকরি, জরিমানা কেটে নিলে বেতনের থাকেই বা কি? তাই খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে তারা ভাড়া করতো নকার- আপারদের।
প্রথম দিকে নক-আপাররা দরজায় ধাক্কা মেরে মানুষকে জাগিয়ে তুলত। কিন্তু এটি ছিলো অকার্যকর এবং ভুল পদ্ধতি। দরজায় ধাক্কা দেয়ার ফলে ঐ পরিবারের সবার ঘুম ভেঙে যেতো, এমনকি প্রতিবেশীরাও অভিযোগ করতে থাকে। কারণ তাদের ভোর ৫-৬ টায় ঘুম থেকে উঠার কোনো প্রয়োজন নেই।
পরবর্তীতে তারা শ্রমিকদের জাগানোর একটি ভাল উপায় খুঁজে পেয়েছিল। যেহেতু বেশিরভাগ শ্রমিকদের ঘুমানোর কক্ষ উপরের তলায় অবস্থিত ছিল, তাই তারা একটি দীর্ঘ লাঠি ব্যবহার করত। সেই শ্রমিকের জানালায় লাঠি দিয়ে আঘাত করতো। কিছু নকার-আপার জানালায় দু-তিনবার ধাক্কা দিয়ে চলে যেতো। আবার কেউ ধাক্কা দিতেই থাকতো যতক্ষণ না কর্মী জানালায় উঠে এসে জানালা খুলতো। প্রতিটি নকার-আপার প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০ জনকে জাগিয়ে তুলতেন।
তবে তখনকার প্রতিটি কর্মী তাদের নিয়োগ করা নকার-আপারের কাছে কৃতজ্ঞ ছিল না, তারা তাদেরকে কখনো পাত্তা দিত না। মাঝেমাঝে তারা উপর থেকে নকার-আপারের উপর বালতি দিয়ে পানি নিক্ষেপ করত।
যদিও কর্মীদের জাগানোর জন্য একজন নকার-আপারকে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে হতো। কিন্তু তারা কিভাবে এতো ভোরে ঘুম থেকে উঠতো? নকার-আপাররা তাদের সকালের দায়িত্ব শেষ করে দিনের বেলা সারাদিন ঘুমাতো আর পেঁচার মতো সারারাত জেগে থাকতো।
বিনিময়ে নকার আপার্সরা ঘুম ভাঙানোর কাজের জন্য সপ্তাহান্তে কিছু টাকা পেতেন। ১৯৪০-৫০ সালের পর চিত্রটা বদলে যায়। ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ডের শহরের চেনা পথগুলোতে আর আগের মতো দেখা যায়নি ভোররাতের ঘুম ভাঙানিদের।
ততদিনে অর্থনীতি, প্রযুক্তি ধীরে ধীরে সহজলভ্য হয়ে উঠছে। বিদ্যুৎ সংযোগ, গানবাজনার সরঞ্জাম, ঘড়ি মানুষের হাতে আসতে শুরু করেছে। ১৯৭০ সালের পর আর খুঁজে পাওয়া যায়নি তাদের। লন্ডন, ম্যাঞ্চেস্টারের চেনা পথে আর দেখা যায়নি নকার-আপার্সদের। কালের নিয়মে তারা কাজ হারায়, থেকে যান ইতিহাস হয়ে।
প্রাচীনপন্থী কিছু মানুষ ১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত উত্তর ইংল্যান্ডের কিছু শহরে নকার-আপারদের নিয়োগ করেছিল, যাতে এই পেশাটা কালের স্রোতে হারিয়ে না যায়।
১৮ ও ১৯ শতকের মানুষরা এভাবেই কাজে যোগদানের জন্য জেগে উঠত। নকার-আপারের পুরানো ইতিহাস চিরকাল স্মরণীয়। কারণ তাদের কাজটি তখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যা ইংল্যান্ডের লোকেদের সময়মতো কাজে পাঠানোর ভূমিকা পালন করতো।
এসডব্লিউএসএস/১৫৪৫
আপনার মতামত জানানঃ