সমকামিতা আর সাধারণ ধার্মিকদের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব বাংলাদেশ, ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশে বিরাজমান; তা দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সাধারণ মানুষ সমকামিতা সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণার সকল ধারণা রাখেন। কারণ, আপনি যখন কোনো কিছুর বিরোধী হয়ে উঠবেন – রাজনীতিবিদদের মত বিরোধ করার জন্য হলেও সে সংক্রান্ত সকল তথ্য আপনার নখদর্পণে থাকা চাই।
বাংলাদেশ বা ভারতের কতজন মানুষ জানে সমকামিতা জীনগত! তারা জানে এটা পাপাচার, ধর্মীয়ভাবে অপরাধ। ঘৃণ্য! এটুকুই! অথচ সমকামিতার সাথে জিনের সংযোগ আছে, এমন তথ্য পাওয়া গিয়েছে ১৯৯৩ সালের ডিন হ্যামারের করা গবেষণায়। ২০১৪ সালে করা বৃহৎ পরিসরে জমজদের উপর করা আরো একটি গবেষণায় এই ফলাফল প্রায় সম্পুর্ণভাবে নিশ্চিত হয়। তবে এতদিন ধরে সুনির্দিষ্ট কোন জিনের জন্য এমনটা হয়; তা নিশ্চিত ছিল না। কিন্তু ২০১৭ এর ডিসেম্বরে নেচারে প্রকাশিত ফলাফল থেকে বলা যায়, এ মুহুর্তে এটা আমরা জানি, সমকামিতার জন্য কোন জিনদ্বয় দায়ী। তাই সমকামিতা যে জিনগত এটা বলতে সম্ভবত এখন খুব একটা দ্বিধা নেই।
চলুন বিস্তারিত জানা যাক। ১৯৯৩ সালে আমেরিকান জেনেটিসিস্ট ডিন হ্যামার কিছু পরিবার পেয়েছিলেন যেখানে মায়ের বংশের দিকে কয়েকজন সমকামী পুরুষ ছিল। এটা পুরুষ সমকামীতার জন্য এক্স ক্রোমোজোমের কোন জিনকে নির্দেশ করে। তিনি দেখান সমকামী ভাইরা এক্স ক্রোমোজোমের একটি ছোট অংশ একে অপরের সাথে শেয়ার করে। তিনি বলেন এই এক্স ক্রোমোজোমের অংশটিতেই (এক্স ক্রোমোজোমের Xq28 মার্কার) এমন কোন জিন আছে যা পুরুষকে সমকামিতার দিকে নিয়ে যায়। তার এই গবেষণাটি NCBI জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এটা এখানে পাবেন।
এরপর ২০০৫ সালের একটি গবেষণায় জিনোমওয়াইড স্ক্যানের মাধ্যমে দেখা যায় যে পুরুষের সমকামিতা আরও তিনটি ক্রোমোজোমের জিনের সাথে সম্পর্কিত।
২০১৪ সালে হিউম্যান জিনোম প্রোজেক্ট দ্বারা প্রাপ্ত জেনেটিক মার্কারগুলো ব্যবহার করে সমকামী ভাইদের নিয়ে একটি বড় গবেষণা চালানো হয়। এই গবেষণাটি পূর্বের এক্স ক্রোমোজোমে থাকা গে জিনকে নিশ্চিন্ত করে। আবার গবেষণাটিতে ক্রোমোজোম ৮ এরও একটি জিনকে গে জিন হিসেবে সনাক্ত করা হয়। এই গবেষণাটি সমাজে আবার নতুন করে হৈচৈ এর জন্ম দেয়। গবেষণাটি সাইকোলজিকাল মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত হয়।
তবে এই গবেষণা গুলো থেকে সমকামিতার সাথে জড়িত সুনির্দিষ্ট কোনো জিন আবিষ্কৃত হয় নি। মূলত ইলিনয়ে অবস্থিত; নর্থ শোর বিশ্ববিদ্যালয়ের এলান স্যাণ্ডারস এবং তার সহযোগীদের একটি গবেষণায় প্রথমবারের মত যৌন অভিমুখিতা বালক ও পুরুষে; গর্ভে ও জীবনকালে কিভাবে ক্রমবিকশিত হয় তা ব্যাখ্যা করতে পারে এরকম স্বতন্ত্র জিন আবিষ্কৃত হয়েছে। তারা এর জন্য ১০৭৭ জন সমকামী ও ১২৩১ জন বিষমকামীর মধ্যে তুলনা করেন। তারা জিনোম ওয়াইড এসোসিয়েশন স্টাডিজ (GWAS) (ডিএনএ স্ক্যানিং এর পদ্ধতি) করেছেন। করেছেন পুরুষের পুরো জিনোমকে স্ক্যান, অন্বেষণ করেছেন, ডিএনএর ক্রমবিন্যাসে অন্তত একটি লেটার ও ভিন্ন কিনা।
এই জন্য গবেষকরা, সেসব ব্যক্তির থেকে লালা বা রক্ত সংগ্রহ করেছেন। তারপর তাকে শ্রেণীবিন্যাসিত করেছেন। তারা পেয়েছেন, এই ভিন্ন প্রকরণ বিশিষ্ট দুটি জিন; যার সাথে যৌন অভিমুখিতার সংযোগ থাকতে পারে।
গবেষকরা পুরো ক্রোমোজম নিয়ে কাজ করার বদলে, ক্রোমোজমে এমন এলাকা খোঁজার চেষ্টা করেছেন, যেখানে বহুসংখ্যক multiple single nucleotide polymorphisms (ডিএনএ তে একক লেটার পরিবর্তিত) থাকে। এরকম এলাকা তারা পেয়েছেন ১৩ ও ১৪ নং ক্রোমোজমের উপর। ১৩ নং ক্রোমোজমের উপর অবস্থিত দৃঢ় সংযোগ টা পাওয়া গিয়েছে SLITRK6 এবং SLITRK5 জিনের মধ্যে। SLITRK6 হচ্ছে নিউরোডেভেলপমেন্ট জিন। এটা ডিয়েনসেফালন (মধ্যমস্তিষ্ক) নামক মস্তিষ্কের একটা অংশে সক্রিয়।
মজার বিষয় হলো এই এলাকাটি হাইপোথ্যালামাসকে ধারণ করে। মজার, কারণ ১৯৯১ সালে দেখা গিয়েছিল সমকামী এবং বিষমকামীর মস্তিষ্কের এই অংশের যে আকার বা সাইজ তাতে পার্থক্য আছে। সাইমন লিভ্যে এটি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি সাম্প্রতিক এই আবিষ্কার দেখে বলেছেন যে, এই জিন আবিষ্কারের ফলে তিনি অত্যন্ত উত্তেজিত কারণ এটা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তার আবিষ্কারটাও যথার্থই ছিল।
অন্য জিনটা পাওয়া গিয়েছে ১৪ নং ক্রোমোজমে এবং এটি প্রধানত থাইরয়েডে সক্রিয়। একে বলা হয় TSHR (thyroid stimulating hormone receptor)। এটি একধরনের রিসেপ্টর প্রোটিন যা শনাক্ত ও আবদ্ধ করে একটি হরমোনকে যা থাইরয়েডকে উদ্দীপ্ত (stimulates) করে। এইভাবেই এই জিনটি থাইরয়েডের ফাংশন বা কার্যাবলীকে নিয়ন্ত্রণ করে।
টিএসএইচআরের বিভিন্ন ধরনের সংযোগ আছে। যেমন এর সাথে জড়িত হিপোপক্যাম্পাস (মস্তিষ্কের অংশ) শর্ট টার্ম মেমোরী (স্বল্প স্থায়ী স্মৃতিকে) দীর্ঘ স্থায়ী স্মৃতিতে পরিণত করে। থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের প্রকৃতির সাথে এই জিন সংযুক্ত। ফ্যাক্ট হলো টিএসএইচআর; যৌন অভিমুখিতা নির্ধারণে জড়িত এমন তথ্যের সাথে এই গবেষণার প্রতিবেদন মিলে যায়। জিনগত অবস্থা- গ্রেইভ ডিজিজের কারণে টিএসএইচআরের কার্যক্রম ব্যাহত হয়; এটি হলো স্বয়ংক্রিয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যা থাইরয়েড গ্রন্থিকে অতি সক্রিয় করে তুলে।
এর ফলে বিপাকীয় ক্রিয়ার হার বেড়ে যায় এবং ওজন হ্রাস পায়। গ্রেইভ ডিজিজ বিষমকামী পুরুষদের তুলনায় সমকামী পুরুষে বেশি দেখা যায় এবং কিছু গবেষণা দেখিয়েছে যে, সমকামী পুরুষরা বিষমকামী পুরুষদের তুলনায় অধিক কৃশকায় (শুকনো) হন। এটা হতে পারে; থাইরয়েডের অতিসক্রিয়তার কারণে। গর্ভবতী মায়ের থাইরয়েডে ত্রুটি দেখা গেলে, সন্তানের পরবর্তী সময়ে সমকামী হবার সম্ভাবনা থাকতে পারে– এরকমটাও একটা গবেষণায় দেখা গিয়েছে। এই সমস্ত প্রাপ্ত তথ্যকে পর্যালোচনা করে এটা প্রায় নিশ্চিয় যে; সমকামিতার সাথে থাইরয়েড গ্রন্থিতে সক্রিয় জিনের একটা সম্পর্ক আছে।
তবে এই গবেষণার গবেষকদের মতে এই অন্বেষণ চিত্তাকর্ষক। এবং এর ফলে সমকামী পুরুষ মানুষদের যৌন অভিমুখিতা বুঝার ক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছে নতুন তথ্য। কিন্তু তবুও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে।
আপনার মতামত জানানঃ