পাহাড়ের ঠিক পাদদেশ থেকে বেরিয়ে আসছে আগুনের লেলিহান শিখা। এঁকেবেঁকে পৌঁছে যাচ্ছে শূন্যে। অথচ, শুষ্ক এই প্রান্তরে মানুষের চিহ্ন নেই কোনো। নেই তেমন কোনো গাছ-গাছালিও। তবে কে জ্বালালো এই আগুন? কে-ই বা জ্বালানি সরবরাহ করে চলেছে এই অগ্নিকুণ্ডে?
আজারবাইজানের অ্যাবসারন অঞ্চলে গেলেই দেখা মিলবে এই আশ্চর্য অগ্নিকুণ্ডের। তার আয়তনও নেহাত কম নয়। কমপক্ষে ১০ বর্গমিটার তো বটেই। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা—সারাবছরই নিরবচ্ছিন্নভাবে জ্বলতে দেখা যায় এই অগ্নিকুণ্ডকে। বৃষ্টি কিংবা তুষারপাতেও নেভে না এই আগুন।
স্থানীয় ভাষায় সে-কারণেই এই অঞ্চলের নাম হয়ে উঠেছে ‘ইয়ানার দাগ’। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘জ্বলন্ত পর্বত’। তবে আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, এই আগুন জ্বলছে আজ থেকে চার হাজার বছর আগে থেকে। অবিরত।
হ্যাঁ, এই আগুন মনুষ্যসৃষ্ট নয়। প্রকৃতি স্বয়ং ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে এই অগ্নিকুণ্ডে। আসলে আজারবাইজানের নিচে লুকিয়ে রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল ভাণ্ডার। মাটির ফাটলের মধ্যে দিয়েই সেই গ্যাস বেরিয়ে আসে বাইরে।
গবেষকদের হিসেব অনুযায়ী, আজ থেকে ৪০০০ বছর আগে প্রথমবারের জন্য লিক করেছিল এই প্রাকৃতিক গ্যাস-চেম্বার। তারপর থেকে অবিরত মিথেন, প্রোপেন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক গ্যাস বেরিয়ে চলেছে সেখান থেকে। তবে এই গ্যাস প্রবাহে কে কবে অগ্নিসংযোগ করেছিলেন— সে-তথ্য এখনও অজানা বিজ্ঞানীদের।
তবে গবেষকরা এই উত্তর দিতে না পারলেও, প্রাচীন সাহিত্যে বহু জায়গায় উল্লেখ পাওয়া যায় এই অগ্নিকুণ্ডের কথা। যেমন ত্রয়োদশ শতকে এই অগ্নিকুণ্ডের সাক্ষী হয়েছিলেন ইতালিয়ান পর্যটক মার্কো পোলো।
প্রাচীন সিল্করুট ধরে ভারতে আসার সময়ই তিনি সন্ধান পান এই জায়গাটির। নিজের ডায়েরিতে ‘ল্যান্ড অফ ফায়ার’ বা ‘অগ্নিক্ষেত্র’ নামে লিপিবদ্ধ করেছেন ‘ইয়ানার দাগ’-এর কথা।
শুধু ইয়ানার দাগই নয়, আজারবাইজান-জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এ-ধরনের একাধিক অগ্নিকুণ্ড। ১৯৫০-এর দশকের পর থেকে একে একে এইসকল অগ্নিকুণ্ড বুঝিয়ে ফেলার কাজ শুরু করে আজারবাইজান প্রশাসন। ব্যবসায়িক ক্ষতির কথা মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেখানকার সরকার।
তবে ‘ইয়ানার দাগ’-সহ আরও বেশ কয়েকটি অগ্নিকুণ্ডকে সংরক্ষিত করা হয়েছে সেখানে। সেগুলিকে কেন্দ্র করেই আজ ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে পর্যটনকেন্দ্র। পাশাপাশি জোরোয়াস্ট্রিয়ানদের কাছে অগ্নিকুণ্ড পবিত্র স্থান। ফলে ধর্মীয় কারণেও রক্ষা পেয়েছে এ-ধরনের কিছু অগ্নিকুণ্ড।
সূত্র মতে, এই আগুনে পাহাড় প্রাচীন জরথুস্ট্রীয় ধর্মে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ধর্মটি ইরানে প্রতিষ্ঠিত হলেও খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে আজারবাইজানে বিকাশ লাভ করে।
জরথুস্ট্রিয়ানদের বিশ্বাস, আগুন মানুষের এবং অতিপ্রাকৃতিক জগতের মধ্যে একটি যোগসূত্র তৈরি করে। আগুন একটি মাধ্যম, যাতে আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি ও প্রজ্ঞা লাভ করা যায়। এটি শুদ্ধ, জীবন ধারণকারী এবং উপাসনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আগুনের শক্তির সঙ্গে আজারবাইজানের প্রাচীন সম্পর্কের সাক্ষী হতে দর্শনার্থীরা আতেশগাহ ফায়ার টেম্পল এবং ইয়ানার দাগের জ্বলন্ত পাহাড়র দিকে ভ্রমণে জড়ো হয়
তবে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এবং গালফ দেশগুলির সঙ্গে পাল্লা দিতে বর্তমানে প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে আজারবাইজান। এভাবে চলতে থাকলে ঠিক কতদিন টিকবে এ-সকল প্রাকৃতিক অগ্নিকুণ্ড কে জানে!
এসডব্লিউএসএস/1850
আপনার মতামত জানানঃ