পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রায়ই বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ আসছে। এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে অর্থ আত্মসাৎ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও অপহরণ। সাম্প্রতিক সময়ে এসব অভিযোগের পরিমাণ আরও বেড়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের গাছা থানায় রিমান্ডে থাকা আসামিকে ভয়ভীতি দেখিয়ে পাঁচটি চেকে জোর করে পাঁচ কোটি টাকা লিখে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী আদালতে অভিযোগ করেছেন।
নগরীর ৩৭নং ওয়ার্ডের কুনিয়া তারগাছ এলাকায় আনোয়ার স্টিল কারখানার সাবেক ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে ৩১ কোটি ৩৩ লাখ ২২ হাজার ২৫১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২ নভেম্বর গাছা থানায় মামলা করে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ।
উল্লেখ্য, মামলায় আনিসুর রহমানের স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে ও শ্যালিকাকেও আসামি করা হয়। গাছা থানা পুলিশ ১০ নভেম্বর মামলার প্রধান আসামি আনিসুর রহমান ও তার শ্যালিকা এন্তেনুর আক্তারকে গ্রেফতার করে।
আনিসুর রহমানের ছোট ভাই আবুল কাশেম বলেন, আনিসুর রহমানকে দুই দফায় রিমান্ডে এনে থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ১৪ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে থাকাবস্থায় ওই দিন রাতে গাছা থানার একদল পুলিশ বড় ভাই আনিসুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে টঙ্গীর পশ্চিম থানার সাতাইশ উত্তর পাড়ার বাসায় তল্লাশি চালায়।
পুলিশ ঘরের আলমিরাসহ যাবতীয় আসবাবপত্র তল্লাশি করে জমির দলিলপত্র, ভাইয়ের সিটি ব্যাংকের চেক বই ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থানায় নিয়ে যায়। পরে থানায় ভয়ভীতি দেখিয়ে পৃথক পাঁচটি চেকে ভাইয়ের স্বাক্ষর নেয়। প্রতি চেকে এক কোটি টাকা করে লিখে নেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, আমার ভাইকে রিমান্ডে নিয়ে কোম্পানির প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এবং তাদের উপস্থিতিতেই চেকে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। আমার ভাই কোনো দুর্নীতি বা কোম্পানির অর্থ আত্মসাৎ করেননি। যে পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে এবং ভাইয়ের যে সম্পদের বিবরণ দেওয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
অভিযোগে বর্ণিত সম্পদের কোনো অস্তিত্বই নেই। এমনকি আমাদের সব ভাইদের সম্পত্তি একত্র করলেও মামলায় বর্ণিত অভিযোগের কিঞ্চিৎ পরিমাণও হবে না।
আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. জাহাঙ্গীর হোসাইন বলেন, থানায় রিমান্ডে নিয়ে জোর করে চেকে স্বাক্ষর নেওয়ার বিষয়টি আমরা আদালতকে জানাই। আদালত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে শোকজ করেন। পরে তদন্তকারী কর্মকর্তা চেকে স্বাক্ষর নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে জবাব দাখিল করলে আদালত আমাদের অভিযোগ খারিজ করে দেন।
মামলার বাদী আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের এজিএম (অ্যাডমিন অ্যান্ড সিকিউরিটি) মো. ইউনুস আলী বলেন, ‘মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামি গ্রেফতার করে আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ডে নিয়েছেন, আমি শুধু বাদী হিসাবে এতটুকুই জানি।’
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গাছা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইহসানুল হক বলেন, থানায় রিমান্ডে এনে আসামির কাছ থেকে জোর করে চেকে স্বাক্ষর নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিচার কার্যক্রম ব্যাহত করার উদ্দেশ্যে এমন অভিযোগ আনা হচ্ছে।
গাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ইব্রাহিম হোসেন বলেন, এটি একেবারে অবান্তর কথা। আসামির এ মিথ্যা দাবি আদালত খারিজ করে দিয়েছেন। আমি যতটুকু জানি, মামলা হওয়ার পর তিনি একটা পর্যায়ে আপস করার চেষ্টা করেছিল। তখন হয়তো ব্যাংক চেক দিয়ে থাকতে পারেন।
উল্লেখ্য, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও পুলিশের সব ইউনিট প্রধানের কাছে প্রতিনিয়ত এমন বিষয়ে অভিযোগ আসছে। গত সাড়ে ৪ বছরে ৬১ হাজারের বেশি অভিযোগ এসেছে বলে সদর দপ্তর সূত্র জানায়। ২০১৭ সালের ১৩ই নভেম্বর সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক আইজিপি কমপ্লেইন সেল চালু করার পর থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশি আসছে।
এসব অভিযোগ নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পুলিশের অপরাধ রুখতে প্রতিটি জেলায় গোয়েন্দাদের নিয়ে বিশেষ টিম গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে জেলা পুলিশ সুপাররা টিম গঠন করার কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গত চার বছরে বিভিন্ন অভিযোগে সারা দেশে প্রায় ৬৫ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গড়ে মাসে ১৩৫৫ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এদিকে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে পুলিশের বিরুদ্ধে প্রায় দেড় হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে। পুলিশ সূত্র বলছে, প্রতিবছরই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বাড়ছে। ২০১৮ সালে ১৪ হাজার ৪০২ জনের বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে। পরের বছর এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৫১২। ২০২০ সালে আরও বেড়ে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ হাজার ২১২। গত বছর ১৬ হাজার ৪১৮ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে।
২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শাস্তি পাওয়া পুলিশের সংখ্যা ১০ হাজার ৪২১ জন। ২০১৬ সালে ১৩ হাজার ৫৮৬, ২০১৫ সালে ১১ হাজার ১৬৭, ২০১৪ সালে ১৫ হাজার ২৯৭, ২০১৩ সালে ১৪ হাজার ৬০ এবং ২০১২ সালে ১২ হাজার ৯৯২ জন পুলিশ সদস্য অপরাধ করে শাস্তি পেয়েছেন। এর মধ্যে চাকরিচ্যুতি বা বরখাস্ত হয়েছে ৫০৬ জন। বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে ৩৬ জনকে।
এসডব্লিউএসএস/১৭০০
আপনার মতামত জানানঃ