ক্যালেন্ডারের পাতায় পহেলা জুন, ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দ। ঝকঝকে এক দিন। কয়েকশ শিশুর গায়ে সাদা জামা। তাদের জন্য জায়গা আগেই ঠিক করা ছিল- বুইন্স আইরেসের এল মনোমেন্টাল স্টেডিয়ামে তারা দাঁড়ালেন সেখানে। আকাশে পায়রা উড়লো। আর শুরু হলো ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত’ বিশ্বকাপ।
মুখে লম্বা গোঁফ, পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুলের সামরিক জান্তা জেনারেল ভিদেলা এর মিনিট খানেক আগে ঘোষণা দিলেন, ‘এই বিশ্বকাপ হবে শান্তির ছায়াতলে।’ টিভিতে ধারাভাষ্যকারের কণ্ঠে ভেসে এলো, ‘তরুণরা যেন কোনভাবেই রাজনীতিতে নিজেদের সম্পৃক্ত না করে।’
শান্তির বার্তার এই ঘোষণা যেখান থেকে আসছে এর কয়েক মিনিটের দূরত্বে ছিল নেভি পেটি অফিসার্স স্কুল অব ম্যাকানিকস- আদতে সামরিক জান্তার টর্চার সেল। ভরদুপুরে অথবা দিনের অন্য কোনো সময়- বিনা কারণে ‘ভিন্ন মতের’ মানুষদের এনে মেরে ফেলা হতো সেখানে।
ভিদেলা কখনও ফুটবল তেমন পছন্দ করতেন না। কিন্তু তিনি বুঝতে ভুল করলেন না, ফুটবল ঢেকে দিতে পারে অনেককিছু। অপকর্ম ঢেকে দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিলেন ফুটবল বিশ্বকাপকে। শুরুটাও হলো রক্তের দাগ দিয়ে।
১৯৭৮ বিশ্বকাপের আয়োজক কমিটির প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল ওমর এক্টিস। নিজের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে যাওয়ার পথে খুন হন তিনি। কেন? ধারণা করা হয়, জনসম্মুখে অর্থনৈতিক দুর্নীতির ব্যাপারে কথা বলতেন বলেই প্রাণ হারাতে হয় তাকে।
ফুটবল বিশ্বকাপে রাজনৈতিক বা ক্ষমতার চর্চা প্রথম ও শেষবার ১৯৭৮ সালে হয়নি অবশ্যই। ১৯৩৪-এ উরুগুয়ে বয়কট করেছিল ইউরোপের বিশ্বকাপ। কারণ হিসেবে তারা বলেছিল, আগের আসরে তাদের মাঠে খেলতে যায়নি ইউরোপের দলগুলো।
১৯৭৩ সালে চিলিতে বিশ্বকাপের প্লে-অফ খেলতে যায়নি সোভিয়েত ইউনিয়নের। তাদের দাবি ছিল, ইস্তাদিয়ো নাকোনাল স্টেডিয়ামের পাশেই বামপন্থীদের জেলখানা। তাই তারা খেলবে না চিলিতে। এমন ঘটনা ইতিহাসে কম নেই একেবারে। তবুও ১৯৭৮ বিশ্বকাপের ক্ষমতার চর্চা চলে গিয়েছিল ‘ঘৃণ্য’ পর্যায়ে।
১৯৭৪ সালেই নির্ধারিত হয় আর্জেন্টিনায় হবে পরের বিশ্বকাপ। দু বছর পর দেশটিতে ক্ষমতা দখল করে ভিদেলের সামরিক জান্তা। এরপর থেকে প্রতিবাদে সরব হয়ে উঠে পুরো বিশ্ব। যদিও স্বাগতিকের ব্যাপারে নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকে ফিফা। আর্জেন্টিনার সামরিক জান্তা প্রতিশ্রুতি দেয়, বিশ্বকাপের সময় ঝরবে না রক্ত।
বিশ্বকাপ যদিও শুরুর আগেই হারিয়ে ফেলে তারকা। ওই সময়ের দুই সেরা ফুটবলার ইয়োহেন ক্রুইফ ও পল বিটনার নিজেদের সরিয়ে নেন এই টুর্নামেন্ট থেকে। অনেক বছর পর ক্রুইফ অবশ্য জানিয়েছিলেন, ‘বার্সেলোনার বাড়িতে ডাকাতির’ মানসিকভাবে বিধ্বস্ত থাকায় বিশ্বকাপে যাননি তিনি। তবুও বেশির ভাগেরই বিশ্বাস ছিল, সামরিক জান্তার প্রতি প্রতিবাদ জানিয়ে অংশ নেননি ক্রুইফ।
প্রতিবাদ, রক্তের দাগের ভেতর বিশ্বকাপ শুরু হলো। রাস্তায় ফ্রিতে দেওয়া হলো আর্জেন্টিনার পতাকা। বর্বর হত্যা আর ক্ষুধার যন্ত্রণায় ক্ষুব্ধ মানুষ সবকিছু ভুলে বেঁচে থাকলো ফুটবলে। রক্তের দাগ মুছে যেতে থাকলো গোলের উৎসবের সঙ্গে। সামরিক জান্তা বুঝলো, এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে নিয়ে যেতে হবে অনেক দূরে।
মাঠের খেলা শুরু হলো। প্রথম ম্যাচে আর্জেন্টিনা হারিয়ে দিলো হাঙ্গেরিকে, ব্যবধানটা অবশ্য কেবল ২-১। রাতে এক সেনা অফিসার এলেন আর্জেন্টিনার ফুটবলারদের ক্যাম্পে। হাসতে হাসতে তিনি এক ফুটবলারকে বললেন, ‘গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়ে গেলে সেটা কিন্তু কেউ ভালোভাবে নেবে না। ’ ফুটবলারটি জানতেন, এই হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে খুনের নেশা। যেভাবে ক’দিন আগে মেরে ফেলা হয়েছে তার বন্ধুকে, নিজেরও হতে পারে একই দশা।
গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়েনি আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয় রাউন্ডে তাদের সঙ্গী হলো ব্রাজিল, পেরু ও পোল্যান্ড। নিয়ম অনুযায়ী তাদের এক দল যাবে ফাইনালে। প্রথম ম্যাচে আর্জেন্টিনা হারালো পোল্যান্ডকে। পরেরটিতে ব্রাজিলের সঙ্গে হলো ড্র। নিজেদের শেষ ম্যাচে সেলেকাওরা আবার জিতে গেল ৩-১ ব্যবধানে। দাঁড়ালো কঠিন এক সমীকরণ।
শেষ ম্যাচে পেরুর বিপক্ষে আর্জেন্টিনাকে জিততে হবে ৪-০ ব্যবধানে। তারা জিতল ৬-০তে। জন্ম নিলো ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিতর্কগুলোর একটি। কারণ ওই সময়ের পেরু বা আর্জেন্টিনার সামর্থ্যের ব্যবধান ছিল না এতটাও। এ নিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে নানা গুজব।
ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমগুলো দাবি করে, পেরুতে বড় গমের চালান যেত আর্জেন্টিনা থেকে। ওই ভয় দেখানো হয়েছিল তাদের। কারো কারো দাবি, আর্জেন্টিনাতে বন্দি ১৩ জন পেরুর মানুষকে মুক্তি দেওয়ার শর্তে ম্যাচটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল আলবিসেলেস্তেদের। পেরুর গোলরক্ষকও আবার ছিলেন আর্জেন্টিনায় জন্ম নেওয়া।
বিতর্ক অবশ্য থেমে থাকেনি সেখানেই। ফাইনালে আর্জেন্টিনা প্রতিপক্ষ হিসেবে পেলো নেদারল্যান্ডসকে। ডাচদের স্টেডিয়ামে আনা হলো অনেকটা পথ ঘুরিয়ে। মাঠে এসেও স্বস্তি পেলেন না দেশটির ফুটবলাররা। তাদের মাঠে এনে আর্জেন্টিনার ফুটবলাররা বসে থাকলেন ড্রেসিং রুমে।
কেন? আর্জেন্টিনার ৭০ হাজার সমর্থক চিৎকারে চিৎকারে অতিষ্ঠ করে ফেলেছিলেন ফুটবলারদের জীবন। মানসিকভাবে ভেঙেচুরমার করে দিয়েছিলেন ডাচদের। পরে হল্যান্ডের এক ফুটবলার বলেছিলেন, ‘তখন এমন অবস্থা হয়েছিল, ৫টি জেট প্লেন উড়ে গেলেও টের পেতাম না আমরা। ’
মাঠের খেলায় শেষ অবধি অতিরিক্ত সময়ে এসে ৩-১ গোলে জয় পেল আর্জেন্টিনা। তাদের হয়ে আলো ছড়ান মারিও ক্যাম্পাস। ছয় গোল করে পেয়েছিলেন ম্যাচ সেরার পুরস্কারও। নির্ধারিত সময়ের বিশ সেকেন্ড বাকি থাকতে অবশ্য রেনেসেনব্রিঙ্কের একটি শট লেগেছিল গোলপোস্টে। ওই গোলটি হয়ে গেলে ইতিহাস হয়তো লেখা হতো অন্যরকমভাবে।
আর্জেন্টিনার সেবারের দলটি একেবারেই খর্বশক্তির ছিল না অবশ্যই। ঝাঁকড়া চুলের ১৭ বছর বয়সী বিস্ময় বালক ডিয়েগো ম্যারাডোনা সুযোগ পাননি বিশ্বকাপে। মারিও ক্যাম্পাসরা খেলেছেন দারুণ, ফাইনালে তার দ্বিতীয় গোলটিই ছিল তিন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে করা। তবুও আলবিসেলেস্তেদের এই জয় ইতিহাসে লেখা হয়েছে খারাপভাবে। কেউ কেউ এটাকে বলে থাকেন ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত বিশ্বকাপ। যদিও আর্জেন্টিনার ফুটবলের ভিত্তপ্রস্তর মজবুত হয়েছিল ১৯৭৮ বিশ্বকাপে।
পর্দার বাইরে কিংবা আড়ালে যতই বিতর্ক থাকুক বিশ্বকাপ শেষ অবধি উঁচিয়ে ধরেছে তারা। ফুটবলাররাও ভালো চোখে দেখেন না অবশ্য এই শিরোপা জয়। বিশ্বকাপজয়ী লুকু যেমন বলেছিলেন, ‘আমার এখনও মনে হয়, এই বিশ্বকাপটি খেলা ঠিক হয়নি। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের মতো হলে আজীবন বুকে লালন করতাম। ’
রাজনৈতিক সমীকরণ, রক্তের দাগ, হত্যাযজ্ঞ বর্বরতাকে ঢেকে দেওয়া এক বিশ্বকাপ। আর্জেন্টিনার জন্য ওই প্রথম। যদিও ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে ‘বিতর্কিত’ বিশ্বকাপে, তারপরও!
এসডব্লিউএসএস/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ