বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার আদালত এলাকায় রবিবার পুলিশের মুখে স্প্রে এবং মারধর করে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামির পালিয়ে যাওয়া নিয়ে সারা দেশে আলোচনা চলছে। কিন্তু এভাবে পুলিশের হেফাজত থেকে বিভিন্ন মামলার অভিযুক্ত বা আসামি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে এটাই প্রথম নয়।
গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে এই বছরের বিশে নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত এক বছরে পুলিশের হেফাজত থেকে এই দুই জঙ্গিসহ অন্তত ১৬ জন আসামির পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বেশিরভাগ ঘটনা ঘটেছে আদালতে আনা নেয়া করার সময়। পাশাপাশি, থানা হাজতখানা অথবা পুলিশি হেফাজতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পালিয়ে যাওয়ার উদাহরণও রয়েছে।
কিন্তু কেন নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজত থেকে একের পর এক আসামি পলায়ন বা ছিনিয়ে নেয়ার মতো ঘটনা ঘটছে? এর পেছনে আসল কারণগুলো কী কী?
পুলিশের গাফিলতি
রবিবার পুলিশের চোখে স্প্রে মেরে ঢাকার আদালত থেকে লেখক অভিজিৎ রায় ও জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামী পালিয়ে গেছে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহিদুল হক বলছেন, তিনি মনে করেন, এর পেছনে পুলিশ সদস্যদের চরম গাফিলতি এবং পেশাদারিত্বের অভাব রয়েছে।
বিশেষ করে জঙ্গিদের কীভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেয়া হবে, সেজন্য একটা লিখিত নির্দেশনা আছে, আমিই তৈরি করে দিয়ে এসেছিলাম। সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার কথা। কথা ছিল, একজন ইন্সপেক্টরের নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ফোর্স থাকবে, আগে পিছে গাড়ি থাকবে। এক্ষেত্রে পুলিশের পক্ষ থেকে চরম গাফিলতি ছিল। নির্দেশনা অনুসরণ করা হয়নি।
এ কে এম শহিদুল হক বলছেন, আর জেল কর্তৃপক্ষও যখন পুলিশ এসকর্ট চেয়েছে, সেখানে তাদের লিখে দেয়া উচিত ছিল, সে জঙ্গি, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য দরকার। এসব কিছুই করা হয়নি। সবাই গতানুগতিক ঢিলেঢালা দায়িত্ব পালন করেছে। জঙ্গি, কিছু হতে পারে, এরকম কোন প্রস্তুতিই ছিল ছিল না।
পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, আদালত পাড়ায় এমনিতেই প্রচুর পুলিশ সদস্য থাকেন। কিন্তু রবিবার যখন দুই জঙ্গি পুলিশের মুখে স্প্রে দিয়ে পালিয়ে যায়, তখন তাদের কেউই ধরতে পারেনি।
সেই সঙ্গে আদালতে উপস্থাপনের সময়টুকু ছাড়া বাকি সময় অর্থাৎ জেলখানা থেকে গাড়িতে তোলা, গাড়ি থেকে আদালতে নিয়ে যাওয়া বা আদালত থেকে গাড়িতে তোলা অথবা হাজতখানায় নিয়ে যাওয়ার সময় জঙ্গি এবং দুর্ধর্ষ আসামিদের হাতকড়া এবং পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে রাখার কথা।
শহিদুল হক বলছেন, আসামি এসকর্ট কীভাবে করতে হয়, সেটা পুলিশের স্বাভাবিক প্রশিক্ষণের মধ্যেই থাকে। কিন্তু এখানে পেশাদারিত্বের অভাব, গুরুত্ব না দেয়ার কারণে এটা ঘটেছে। সেই সঙ্গে সেখানে তদারককারী যে কর্মকর্তারা ছিলেন, তাদেরও দায়িত্বহীনতা কাজ করেছে।
ঢাকার আদালত এলাকা থেকে জঙ্গিদের পালিয়ে যাওয়ায় গাফিলতির অভিযোগে আদালত এলাকায় নিরাপত্তা দায়িত্বে থাকা একজন পরিদর্শকসহ পাঁচ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
তবে মানবাধিকার কর্মী এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক নুর খান লিটন বলছেন, গতকালের ঘটনায় প্রমাণিত হচ্ছে, শস্যের মধ্যেই ভুত আছে। শুধুমাত্র এখানে পুলিশের গাফিলতি নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাফিলতি, এবং ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলোরও এক ধরনের ব্যর্থতা আছে। কারণ জঙ্গিরা যে এরকম একটি ঘটনা ঘটাতে পারে, সেরকম কোন তথ্য তাদের কাছে ছিল না।
পুলিশ-আসামির সখ্যতা আর দুর্নীতির দায়
যদিও এসব ঘটনায় বরাবরই দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের গাফিলতিকে দায়ী করেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। অভিযুক্ত সদস্যদের বিরুদ্ধে সাময়িক ব্যবস্থাও নেয়া হয়।
কিন্তু নূর খান লিটন বলছেন, বারবার এ ধরণের ঘটনা ঘটার পরেও সেটি প্রতিরোধে তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি।
তিনি বলছেন, এই ঘটনাগুলো ঘটার পরে দুই-একদিন তৎপর থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু তারপরে পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়। সামগ্রিকভাবে একটা নজরদারি তৈরি করা, পরিকল্পনা তৈরি করে কাজ করা- এটার অভাব আমরা লক্ষ্য করেছি। এই ব্যাপারে যতটা গুরুত্ব দেয়া দরকার, সেটা হচ্ছে না। বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নানা কাজে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার কাজে ব্যবহার করার কারণে তাদের আসল কাজটা ঠিক মতো হয় না।
সূত্র মতে, কোন মামলায় গ্রেপ্তার হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তি বা আসামিদের আনা-নেয়া বা পাহারা দেয়ার কাজে নিয়োজিতদের মধ্যে অনেক সময় সখ্যতা গড়ে ওঠে। এমনকি অর্থের বিনিময়ে আদালত বা থানার হাজতখানায় থাকার সময় মোবাইল ফোনে কথা বলতে দেয়া, খাবার সরবরাহ করা, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, জিনিসপত্র গ্রহণের মতো সুযোগ করে দেয়া হয়।
একটি মামলায় একদা অভিযুক্ত একজন ব্যক্তি নাম গোপন রাখার শর্তে এক সংবাদদাতাকে বলেছেন, আদালতের হাজতের পাহারার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের টাকা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একত্রে বসে হাজতখানায় খাওয়া-দাওয়ারও সুযোগ পেয়েছেন।
ফলে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নজরদারি বা পাহারায় তাদের এক ধরনের অবহেলা তৈরি হয়। আর এই সুযোগ ব্যবহার করেই পাহারার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
নুর খান লিটন বলছেন, ‘’বিগত দিনে আমরা দেখেছি, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভ্যন্তরে এই জঙ্গিদের এক ধরনের প্রভাব ছিল। যেহেতু আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরে অনৈতিক চর্চার বিষয় রয়েছে- যেমন ঘুষ-দুর্নীতি, সেটা দিয়ে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া। এই ক্ষেত্রে যতটা গুরুত্ব দেয়া দরকার ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সেটা দেয়া যে হয়নি তা এখন স্পষ্ট।”
পুলিশের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন
কীভাবে মামলার অভিযুক্তদের আদালতে আনা-নেয়া করতে হবে, দুর্ধর্ষ বা জঙ্গি আসামিদের ক্ষেত্রে কি ব্যবস্থা নিতে হবে, পুলিশের কাছে সে বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বাস্তবে সেসব প্রক্রিয়া খুব একটা অনুসরণ করা হয় না।
একসময় আদালত এলাকায় কাজ করেছেন, পুলিশের এমন একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ লাইন্স থেকে একেক সময়ে একেক সদস্য এসব ডিউটিতে আসেন। তাদের এসব নিয়মকানুনের বিষয় ভালোমতো জানাও থাকে না।
তিনি বলছেন, একেকটি গাড়িতে আনা আসামিদের তুলনায় পুলিশের সদস্য সংখ্যাও কম থাকে। সিনিয়র অফিসাররা খুব বেশি নজরদারি করেন না। আসলে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা তো প্রতিদিন ঘটে না। ফলে আমাদের মধ্যেও একটু ঢিলেঢালা ভাব থাকে। আবার নিয়মিত আনা-নেয়ার ফলে অনেকের সঙ্গে একটা মুখ-চেনা ব্যাপারও হয়ে যায়। ফলে কেউ হঠাৎ পালানোর চেষ্টা করলে টের পেতেও একটু সময় লাগে।
তবে রবিবার যেভাবে পুলিশের ওপর হামলা করে দুই জঙ্গি পালিয়ে গেছে, তাতে পুলিশের প্রস্তুতি আর দক্ষতার যথেষ্ট অভাব ছিল বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র মোঃ মনজুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, পুলিশ সব সময়েই দায়িত্বশীলতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের চেষ্টা করে। সেভাবেই পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, নির্দেশনা দেয়া হয়।
কিন্তু কখনো কখনো এর মধ্যে দিয়েও আসামি পালিয়ে যাওয়ার মতো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে যায়। তবে সেরকম সব ঘটনাতেই তদন্ত করা হয়, দায়িত্বে অবহেলা থাকলে তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সবসময়েই ব্যবস্থা নেয়া হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ