ইতিহাসে তিনি মহান আলেকজান্ডার নামে পরিচিত। তার মৃত্যুর পর কেটে গিয়েছে প্রায় আড়াই হাজার বছর। কিন্তু আজও ইতিহাস ও জনশ্রুতিতে তিনি বিশ্বজয়ী বীর। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটকে নিয়ে চর্চা তবু থামছে না।
একদিকে তার অসামান্য উত্থান, বিশ্বজয়ের স্বপ্ন, ভারত আক্রমণ- একের পর এক অধ্যায় নিয়ে আলোচনার অন্ত নেই। অন্যদিকে আলেকজান্ডারের মৃত্যুরহস্য বোধহয় বাকি সব কিছুকেই ছাপিয়ে গিয়েছে। ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মাত্র ৩২ বছর বয়সে এই সম্রাটের মৃত্যু হয়। মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ডও বলছেন কেউ কেউ। আবার অনেকের মতে, সাধারণ অসুখেই ১২ দিন ভুগে চলে যেতে হয়েছিল দোর্দণ্ডপ্রতাপ যোদ্ধাকে। কিন্তু মৃত্যুর পর নাকি টানা ৬ দিন সেই দেহে কোনো পচন ধরেনি! এ এক আশ্চর্য রহস্য।
ঠিক কীভাবে মারা গিয়েছিলেন আলেকজান্ডার? সত্য়িই কি তার মৃতদেহে পচন ধরেনি? ইতিহাসবিদ জাস্টিন ও কার্টিয়াসের মতে হেলিবার ও স্ট্রিকনাইন বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল তাকে। খোদ গ্রিসের ভাইসরয়ের ছেলে নাকি ছিলেন এই চক্রান্তের পেছনে। সেই বিষ খচ্চরের খুরে করে লুকিয়ে আনা হয়েছিল এমনও জানা যায়। পরে পানীয়র মধ্যে তা মিশিয়ে দেওয়া হয়। আবার এমন মতামতও রয়েছে, ম্যালেরিয়া কিংবা টাইফয়েডে ভুগেই মৃত্যু হয়েছিল তার।
আসলে এত আকস্মিকভাবে আলেকজান্ডারের মৃত্যু হয়েছিল, তাই নানা রকম সংশয় ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু এমন অনেক থিয়োরির মধ্যে একেবারে নতুন একটি দাবি উঠে আসে ২০১৮ সাল নাগাদ। নিউজিল্যান্ডের ডুনেডিন স্কুল অফ মেডিসিনের প্রবীণ অধ্যাপক ড. ক্যাথরিন হলের দাবি, এক আশ্চর্য অসুখে আক্রান্ত হয়েছিলেন আলেকজান্ডার। যার নাম গুলিয়ানি বার সিনড্রোম।
ঠিক কী হয় এই অসুখে? সারা শরীরে পক্ষাঘাত হয়ে যায়। ফলে শ্বাসপ্রশ্বাসও চলে খুব ক্ষীণগতিতে। সেই যুগের যে চিকিৎসা পদ্ধতি, তাতে সেই শ্বাসকে চিহ্নিত করাই কঠিন। কেননা নাড়ি দেখার যে পদ্ধতি তা তখনো অধরা। ফলে একেবারে স্থবির হয়ে যাওয়া দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্রাটকে দেখে ‘মৃত’ বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। আর সেই যুক্তিতেই ৬ দিন ধরে তার দেহ অবিকৃত থাকার যুক্তিটিও পরিষ্কার হয়। সম্ভবত ঐ কয়েক দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরই আলেকজান্ডারের ‘প্রকৃত’ মৃত্যু হয়। হল এবিষয়ে বলতে গিয়ে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানিয়েছেন, আলেকজান্ডারের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ কী সেই বিষয়ে আমি নতুন করে আলোকপাত করতে চাই। ইতিহাস বইয়ে যা লেখা রয়েছে তা এবার বদলে ফেলার সময় এসেছে।
ঠিক কী হয়েছিল? খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সালে ৩২ বছরের আলেকজান্ডার এসে পৌঁছান ব্যাবিলনে (আজকের দিনে যা ইরাকের অংশ)। সেখানে রাতভর মদ্যপান করেন তিনি। পরের দিনও ‘পার্টি’ চলে। এরপরই আচমকা জ্বরে ভুগতে থাকেন আলেকজান্ডার। সেই সঙ্গে পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা। যেন কেউ ছুরি মেরেছে। তেষ্টায় গলা ফেটে যাচ্ছে। অথচ মদ গলায় ঢাললেও তৃষ্ণার নিবৃত্তি হচ্ছে না। এভাবে চলতে চলতেই কথা বলা, নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায় তার। ঠিক ১২ দিন পরে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু চিকিৎসকরা মৃত বলে ঘোষণা করলেও দেখা যায় আলেকজান্ডারের দেহে কোনো পচন ধরেনি। দেহ রয়েছে একেবারে অবিকৃত। এমন দৃশ্য দেখে সকলেই অবাক হয়ে যান। গ্রিক দার্শনিক প্লুটার্কের লেখা রয়েছে, মৃত্যুর পর ৬ দিন পেরিয়ে গেলেও দেখা যায় দেহ অবিকৃত। সেই সময় সম্রাটের অনুরাগীদের বদ্ধমূল ধারণা হয়, আলেকজান্ডার মানুষ নন।
অনেক মানুষ এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজার প্রতাপের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাকে ঘিরে এমনিতেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ একটা ইমেজ। মৃত্যুর পরের অবিকৃতি তাই অনেকের কাছেই বিস্ময়কর বলে মনে হয়নি। বরং রীতিমতো সাড়া পড়ে যায়।
তবে ৬ দিনের পর থেকে দেহটি পচতে শুরু করে। তখন সেই দেহটি রাখা হয় মানুষের আকৃতির সোনার তৈরি কফিনে। সেটাকে আবার ঢোকানো হয় আরেকটি স্বর্ণখচিত বাক্সে। এমনকী কফিনবাহী গাড়িটিতেও বহু নকশা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সব বৈভবের মধ্যে জেগেছিল এই প্রশ্ন। কেন অবিকৃত ছিল আলেকজান্ডারের দেহটি?
ইতিহাস আসলে এত দূরের কাহিনি যে সমস্ত চিহ্নকে প্রমাণ হিসেবে দেখায় আমরা সম্ভাবনাগুলো ঝালিয়ে নিতে পারি। তারপর এর মধ্যে সবচেয়ে মজবুত যুক্তিটিকেই বেছে নেয়া হয়। সেই হিসেবে আলেকজান্ডারের প্রকৃতই ঐ অসুখ হয়েছিল কিনা তা বলা দুষ্কর। কিন্তু গুলিয়ানি বার সিনড্রোমের লক্ষণগুলো দিয়েই বোধহয় প্রায় সপ্তাহখানেক একটি মৃতদেহের অবিকৃত থাকার রহস্যকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। তাই এই যুক্তিকেই সবচেয়ে জোরাল বলে মনে করা হচ্ছে।
ইতিহাসে এমন মৃত্যুরহস্য অবশ্য আরো রয়েছে। সে তুতেনখামেন হোক বা ক্লিওপেট্রা। কেবল কার্যকারণ বিচার করে, সূত্র ধরে ধরে সত্যের কাছে পৌঁছানোর প্রয়াস করা যায় মাত্র।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭০০
আপনার মতামত জানানঃ