ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ভিন্নমত দমনে সরকারের কাজে লেগেছে, কিন্তু জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি বলে জানিয়েছেন আর্টিকেল নাইনটিন দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল।
তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ডিজিটাল মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আর্থিক লেনদেনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারছে না। এমনকি হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মতো ঘটনার প্রতিকারের ক্ষেত্রেও এটি কোনো কাজে আসছে না।
রাজধানীর বনানীর ঢাকা আর্ট গ্যালারিতে সম্প্রতি এডিটরস গিল্ড বাংলাদেশের উদ্যোগে আয়োজিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিতর্ক’ বিষয়ক গোলটেবিল বৈঠকে আর্টিকেল নাইনটিন দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল এসব কথা বলেন। এডিটরস গিল্ড সভাপতি ও একাত্তর টিভির প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবুর সঞ্চালনায় বৈঠকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে ফারুখ ফয়সল বলেন, বাংলাদেশ স্বাক্ষরিত মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক সনদগুলোর সঙ্গে প্রচলিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংঘর্ষিক। এ আইনে কোনো পূর্বানুমতি ছাড়া এবং আত্মপক্ষের সুযোগ না দিয়ে যে কাউকে গ্রেফতার করা যায়। এমনকি আইনের বেশিরভাগ ধারাই জামিন অযোগ্য, যা একজন ব্যক্তির মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন।
তিনি বলেন, সব মানুষের নির্ভয়ে মতপ্রকাশের ও জানার অধিকার থাকতে হবে। একই সঙ্গে হেট স্পিচ (বিদ্বেষমূলক বক্তব্য), ভুল তথ্য ও অপতথ্য ছড়ানো যাবে না। এগুলো প্রতিরোধে গণমাধ্যমে ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্য ফ্যাক্ট-চেকিং ব্যবস্থা থাকতে হবে।
প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ডিজিটাল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রবিধান এবং ওটিটি পরিষেবা প্রদান সংক্রান্ত নীতিমালা নাগরিকদের অধিকার ও ডিজিটাল মাধ্যমে মতপ্রকাশের পরিসরকে আরও সংকুচিত করবে মন্তব্য করে ফারুখ ফয়সল বলেন, এসব আইনের মাধ্যমে মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং জনগণের উপাত্তের ওপর সরকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে।
এসময় তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধনের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাকস্বাধীনতা বা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করার জন্য হয়নি। সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের ফলে বর্তমানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ অনেক কমেছে। সরকার এ আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধ করার চেষ্টা করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।
কার্টুনিস্ট কিশোরকে পুলিশি হেফাজতে ৩০০ দিন আটক রাখা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, যেকোনো ইমপ্লিমেন্টের সময় কিছু অপব্যবহার হয়। আপনি কি মনে করেন আমরা কান বন্ধ করে রেখেছি। উই আর ট্রাইয়িং টু সলভ দিজ। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, অজামিনযোগ্য মানে এই না যে, সে কোনো দিন জামিন পাবে না। তাকে পুলিশ থানা থেকে তাকে ছাড়তে পারবেন না। বিজ্ঞ আদালত বিবেচনা করবেন তাকে জামিন দেবেন কি দেবেন না। আপনাদের এই আইনভীতি দূর করার জন্য কী কী করা দরকার, আমরা আপনাদের সঙ্গে বসে করব। ডেটা প্রটেকশন অ্যাক্ট নিয়ে আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। ডেটা কন্ট্রোল করার জন্য এই আইন না, আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি। বিশ্বের যে মান, তার সঙ্গে মিলিয়ে আইন করা হবে।
গণমাধ্যমের অংশ বলছে এই আইন গণবিরোধী, সরকার বলছে জনগণের জন্য। তাহলে তো পত্রিকাগুলোকে শুধু বিজ্ঞপ্তি ছাড়তে হবে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বন্ধ করতে হবে।
বৈঠকে মূল নিবন্ধ পাঠ করেন এডিটরস গিল্ড বাংলাদেশের যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা। তিনি বলেন, এ আইনের চার বছর হয়ে গেল। দুই বছর আগে এই আইনে আটক সাংবাদিক মুশতাকের মৃত্যু হয়। বন্ধ হয়ে গেছে কার্টুন। পত্রিকাগুলোয় প্রায় উঠে গেছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। উপাত্ত সংরক্ষণ আইন এটি মানুষের ক্ষতি করবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এমন কথা বলছে।
আলোচনায় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সংস্কৃতিজন বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, আমি যদি নাটকে এমন কিছু দেখাই, মুচির চরিত্র, পুলিশের চরিত্র; যদি পুলিশের চরিত্র একটু নেগেটিভভাবে তুলে ধরি, মামলা দিয়ে দিচ্ছে।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট সোহরাব হাসান বলেন, আইনের একটা উদ্দেশ্য থাকে, সেটা হচ্ছে জনগণকে সুরক্ষা করা। এখন সেই আইন যদি জনগণকে তার স্বাধীনতা বন্ধ করতে চায়, তাহলে সেই আইন আর জনগণকে সুরক্ষা করতে পারে না। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এই আইন ব্যবহƒত হয়। আরেকটা জিনিস হলো আইন যদি খুব বেশি হয়, তাহলে বুঝতে হবে সরকারের দুর্বলতা আছে। বলা হয়েছিল যে, জনগণকে হয়রানির জন্য এই আইন ব্যবহার করা হবে না। কিন্তু একজন থানার কর্মকর্তা হলেন, এই আইনের প্রয়োগকারী। মুশতাক যে মারা গেলেন, তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ খুবই ঠুনকো। গণমাধ্যমের অংশ বলছে এই আইন গণবিরোধী, সরকার বলছে জনগণের জন্য। তাহলে তো পত্রিকাগুলোকে শুধু বিজ্ঞপ্তি ছাড়তে হবে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বন্ধ করতে হবে।
চলচ্চিত্র নির্মাতা কামার আহমাদ সায়মান বলেন, সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে এই আইন অনুসরণ করা যাবে না। তার মানে, সাধারণ লোকজনকে এই আইনে জড়ানো যাবে। এই অ্যাপ্রোচ নিয়ে আমার আপত্তি আছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সভাপতি জেড আই খান পান্না বলেন, এই আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধ করেন। সন্ধ্যার পর কেন আপনারা বাসায় যাবেন। আপনি রেড করতে যাবেন, আমি হার্টের রোগী। আমার পাশে ছোট বাচ্চা, সে তো ভয় পাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৬
আপনার মতামত জানানঃ