বিরোধী দলের কর্মসূচিতে জনসমাগম ঠেকাতে গণপরিবহন বন্ধের রাজনীতির মূল্য দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগের সমাবেশ ঠেকাতে মালিকদের দিয়ে গণপরিবহন ‘বন্ধ করাত’ বিএনপি। অঘোষিত হরতালের এই কৌশল এখন বিএনপির বিরুদ্ধে ‘প্রয়োগ’ করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এতে সমাবেশে জনসমাগম যতটা না কমে, তার বহু গুণ ভোগান্তি হয় সাধারণ মানুষের।
বিএনপির পরবর্তী সমাবেশ খুলনায়, আগামী শনিবার। এরপর পর্যায়ক্রমে বাকি বিভাগীয় সদরে হবে। সর্বশেষ ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে দলটি। এদিকে ৬ নভেম্বর থেকে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। ১০ ডিসেম্বর পরীক্ষা না থাকলেও তার আগে–পরে আছে। এ কারণে বিএনপিকে মহাসমাবেশ করতে দেওয়া হবে কি না, সেটা নিয়েও আলোচনা আছে। শেষ পর্যন্ত করতে দিলেও উপস্থিতি কমানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে বলে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগ ও সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ঢাকার বাইরের বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে মানুষের উপস্থিতি কমাতে যানবাহন বন্ধ করে দেওয়া, পুরোনো মামলার আসামিদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে চাপ দেওয়া, কিছু কিছু স্থানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি রাখার পরিকল্পনা আছে।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকে যাতে মানুষ কম আসতে পারে, সে জন্য যানবাহন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় বিএনপি যেসব সভা-সমাবেশ করেছে, সেগুলোতে আশপাশের এলাকা থেকে প্রচুর মানুষ এসেছে। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও পুলিশের পক্ষ থেকে এসব স্থান এবং সেখান থেকে কী ধরনের যানবাহন চলাচল করে সে বিষয়ে পর্যালোচনা করেছে। সেই পর্যালোচনা ধরে ১০ ডিসেম্বরের বিএনপির মহাসমাবেশে জমায়েত কমাতে কাজ করা হবে।
খুলনায় যানবাহন বন্ধ ঘোষণা
চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহের পর এবার বিএনপির গণসমাবেশে জনসমাগম ঠেকাতে আরেক ধাপ এগিয়ে খুলনা। চট্টগ্রামে প্রথম সমাবেশে যেতে বিক্ষিপ্ত হামলা ও বাধা দেওয়া হয়েছিল। এরপর ময়মনসিংহে হামলা ও বাধার সঙ্গে এক ধাপ এগিয়ে সড়কপথে সব যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল পূর্বঘোষণা ছাড়াই। এবার খুলনায় সমাবেশের দুই দিন আগেই বাস চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা এল।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, খুলনায় বাস চলাচল বন্ধের অভিনব কৌশল নিয়েছে ‘খুলনা জেলা বাস, মিনিবাস, কোচ, মাইক্রোবাস মালিক সমিতি’। গতকাল বুধবার দুপুরে সংগঠনটি গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে বলেছে, ‘সড়ক ও মহাসড়কে অবৈধভাবে নছিমন, করিমন, মাহেন্দ্র, ইজিবাইক ও বিআরটিসির গাড়ি চলাচল করছে। আগামী ২০ অক্টোবরের মধ্যে প্রশাসন যদি সড়কে ওই অবৈধ যান চলাচল ও কাউন্টার বন্ধ না করে, তাহলে পরবর্তী দুই দিন ২১ ও ২২ অক্টোবর মালিক সমিতির সব রুটের গাড়ি বন্ধ থাকবে।’
ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকে যাতে মানুষ কম আসতে পারে, সে জন্য যানবাহন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
বিএনপির ২২ অক্টোবরের সমাবেশ ঠেকাতে এ সিদ্ধান্ত কিনা প্রশ্নে জেলা বাস-মিনিবাস কোচ মালিক সমিতির সহসভাপতি কাজী এনায়েত হোসেন বলেছেন, সরকার বা আওয়ামী লীগের কেউ কিছু বলেনি। বিএনপির কর্মসূচিতে বাসে ভাঙচুর ও আগুনের আশঙ্কা রয়েছে। মালিকরা বাস চালাতে চাইছেন না। তাই সমিতি বাস বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অতীতে বিরোধীদের কর্মসূচি ঠেকাতে গণপরিবহন বন্ধ করা হলেও এভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়নি। গত শুক্র ও শনিবার ময়মনসিংহমুখী সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ হলেও মালিকরা আগাম ঘোষণা দেননি। আইনে বাস বন্ধের সুযোগ না থাকলেও এবার ঘোষণা দিয়েই গণপরিবহন বন্ধ রাখছেন মালিকরা।
খুলনায় গণসমাবেশের অনুমতি পেয়েছে বিএনপি। অনুমতি দিয়েও তা আটকাতে গণপরিবহন বন্ধের কৌশলের নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বিএনপি জনসমর্থন দেখাতে বড় জমায়েত করতে চাইছে। জনসমাগম আটকিয়ে আওয়ামী লীগ দেখাতে চাইছে বিএনপির জনসমর্থন নেই। সে কারণেই জনগণকে কষ্টে ফেলা গণপরিবহন বন্ধের কৌশল নেওয়া হয় বলে দল দুটির সূত্র জানিয়েছে।
খুলনা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা বলেন, গণসমাবেশ বাধাগ্রস্ত করতে সরকারের নির্দেশে গণপরিহন বন্ধ করা হয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও অব্যাহতভাবে এই অভিযোগ করেছেন।
বিএনপির বড় জমায়েত ঠেকাতে যা করছে আ’লীগ
বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে বিপুল মানুষের উপস্থিতি এবং তাদের মরিয়া ভাব ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে কিছুটা ভাবনায় ফেলেছে। আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশে কী হবে—এরই মধ্যে সে আলোচনাও শুরু হয়েছে। এই আলোচনা যাতে বেশি দূর না গড়ায় এবং সরকার দুর্বল হয়ে গেছে এমনটা যাতে প্রকাশ না পায়, সেটি দেখাতে চাচ্ছে আওয়ামী লীগ।
এ জন্য বিএনপির বিভাগভিত্তিক পরবর্তী সমাবেশগুলোতে লোক জমায়েত কঠিন করে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে আওয়ামী লীগ। সরকার ও আওয়ামী লীগের বিশেষ নজর ১০ ডিসেম্বর ঢাকার মহাসমাবেশের দিকে। এতে বিএনপি যাতে বিপুল জমায়েত না ঘটাতে পারে, সে জন্য নানা কৌশল নিয়ে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের ভেতর আলোচনা চলছে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, বিএনপি ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিপুল মানুষ এনে সরকারকে চাপে ফেলে দেবে—এমন একটা প্রচারণা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় বিএনপিকে একেবারে বিনা বাধায় সমাবেশ করতে দিলে আওয়ামী লীগের কর্মীদের মধ্যে ভুল বার্তা যেতে পারে। তাদের মনোবলে ধাক্কা লাগতে পারে। সরকার চাপে পড়ে বিএনপিকে জায়গা দিতে বাধ্য হচ্ছে, এমন ধারণা তৈরি হতে পারে।
আওয়ামী লীগের ওই সূত্রটি আরও জানায়, বিএনপি একের পর এক সমাবেশ কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। জমায়েতও চোখে পড়ার মতো। বিএনপির এসব কর্মসূচি, সমমনা দলগুলোর সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক, বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ; এসবের পেছনের কারণ বোঝার চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ।
সরকারের ভেতরের সূত্র বলছে, গত রোববার তথ্য সচিব মকবুল হোসেন এবং মঙ্গলবার পুলিশ সুপার পদমর্যাদার তিনজনকে বাধ্যতামূলকভাবে অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্তের পর নানা অনুমান-আলোচনা জোর পেয়েছে। তবে এসব সিদ্ধান্তের সঙ্গে বিএনপির আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ এসব সিদ্ধান্ত। সামনের দিনগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আস্থাভাজন ব্যক্তিদের বসানো এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের সরিয়ে দেওয়ার কাজ অব্যাহত থাকবে।
এর আগে ময়মনসিংহে লাখো যাত্রী চরম দুর্ভোগ পোহান। বহু মানুষ আটকা পড়েন শহরটিতে। পার্শ্ববর্তী জেলা-উপজেলা থেকে ময়মনসিংহমুখী অটোরিকশা, রিকশাও চলেনি। পথে পথে মহড়া ও পাহারা দেয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। হাজারো মানুষ হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছান। এসএসসি পরীক্ষার্থী চরম দুর্ভোগে পড়ে গণপরিবহন বন্ধে। খুলনার যাত্রীদেরও একই রকম ভোগান্তিতে পড়তে হবে। তা ঠেকাতে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। যদিও যানবাহন সচল রাখা সরকারেরই দায়িত্ব।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সভা-সমাবেশ সাংবিধানিক অধিকার। তা খর্ব করতে গণপরিবহন বন্ধ করলে জনগণেরই দুর্ভোগ বাড়ছে। মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রতি জনগণের সমর্থন বাড়ে না। জনসভায়ও লোকসমাগম কমে না। এ রকম কার্যক্রমে সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ পায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৭
আপনার মতামত জানানঃ