বিলকিস বানুর ধর্ষকদের মুক্তি নিয়ে উত্তপ্ত ভারতের রাজনীতি। এমন নৃশংস অপরাধের সঙ্গে যুক্তদের মুক্তি কেন? এ নিয়ে সরব হয়েছে বিরোধীরা। এই মুক্তি আদৌ আইন মেনে হয়েছে কিনা, তা নিয়েও জেগেছে প্রশ্ন।
ভারতের গুজরাট রাজ্যে ২০০২ সালের দাঙ্গার সময় বিলকিস বানু নামে এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত ১১ জন ছাড়া পান গত ১৫ আগস্ট। সম্প্রতি গুজরাট সরকার ভারতের সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই তাদের মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত আগস্টে ভারতের স্বাধীনতা দিবসে যখন ওই ১১ দণ্ডপ্রাপ্তকে মুক্তি দেওয়া হয় তারপর গুজরাট সরকার সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছিল তাদের ভালো আচার-ব্যবহারের কারণেই ১৪ বছর সাজা ভোগের পর মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। তবে স্থানীয় সময় সোমবার এক হলফনামায় গুজরাট সরকার সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই তাদের মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
সুপ্রিম কোর্টে ওই ১১ দণ্ডপ্রাপ্তকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে তিনটি পিটিশন দায়ের করা হয়। সেই পিটিশনগুলোর শুনানির সময় গুজরাট সরকার আদালতকে এই তথ্য জানায়।
হলফনামায় গুজরাট সরকার আদালতকে জানিয়েছে, চলতি বছর ১১ জুলাই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশের মাধ্যমে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই মুক্তি দেওয়া হয়।
২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার সময় বিলকিস বানু ধর্ষণের শিকার হন। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা বিলকিসকে ধর্ষণ করার পাশাপাশি তার তিন বছরের মেয়েসহ পরিবারের সাত সদস্যকে হত্যা করা হয়। ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ের বিশেষ সিবিআই আদালত ১১ অপরাধীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেন। বোম্বে হাইকোর্টও সেই সাজা বহাল রাখেন। ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে ১৪ বছর সাজাপ্রাপ্ত ওই ১১ জনকে গুজরাট সরকার ক্ষমা প্রদর্শন করে মুক্তি দেয়। গুজরাটের গোধরা জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ওই অপরাধীদের ফুলের মালা পরিয়ে কপালে তিলক কেটে মিষ্টি খাইয়ে বরণ করা হয়। এ ঘটনা ভারতজুড়ে বিক্ষোভের জন্ম দেয়।
দণ্ডিত ব্যক্তিরা মুক্তি পাওয়ার পর ২৩ আগস্ট গুজরাট সরকারের ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন সিপিএম নেত্রী সুভাষিণী আলী, তৃণমূল কংগ্রেস সংসদ সদস্য মহুয়া মৈত্র, সাংবাদিক রেবতী লাল ও অধ্যাপক রূপরেখা ভার্মা। প্রধান বিচারপতি এন ভি রমনা, বিচারপতি অজয় রাস্তোগী ও বিচারপতি বিক্রম নাথের এজলাসে ২৫ আগস্ট সেই মামলার প্রথম শুনানিতে গুজরাট সরকারকে নোটিশ পাঠানোর নির্দেশ দেন।
অপরাধীদের শুধু ফুল, মালা, মিষ্টিতেই বরণ করে নেওয়া হয়নি, তাদের ব্রাহ্মণ পরিচয় দেখিয়ে সংস্কারী আখ্যাও দিয়েছেন বিজেপির এক বিধায়ক।
স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন গুজরাট সরকার মুক্তি দেয় বিলকিস বানু গণধর্ষণ কাণ্ডে যাবজ্জীবন সাজা প্রাপ্ত এগারো জনকে। শীর্ষ আদালতে সাজা কমানোর আর্জি জানিয়েছিল এক আসামি। তারপরে সুপ্রিম কোর্ট গুজরাট সরকারকে কমিটি গড়ে বিষয়টি পর্যালোচনা করতে বলেছিল। তার পরেই সেই কমিটির অনুমোদন নিয়ে হঠাৎ করেই চোদ্দই অগাস্ট অর্থাৎ ভারতের স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন মুক্তি দেওয়া হয় এগারো জন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে।
ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা গেছে, মুক্তির পর ওই ১১ জন লাইন ধরে গোধরা জেলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন, তাদের আত্মীয়রা তাদের মিষ্টিমুখ করাচ্ছে, কখনও কখনও পা ধরে আশীর্বাদও নিচ্ছে।
অপরাধীদের শুধু ফুল, মালা, মিষ্টিতেই বরণ করে নেওয়া হয়নি, তাদের ব্রাহ্মণ পরিচয় দেখিয়ে সংস্কারী আখ্যাও দিয়েছেন বিজেপির এক বিধায়ক। এ নিয়েও দেশের বিভিন্ন মহলে সমালোচনা শুরু হয়।
এই ১১ জনকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্তকে ‘মহা অন্যায়’ অ্যাখ্যা দিয়ে বিলকিস বলেছেন, এই ঘটনা বিচার ব্যবস্থার প্রতি তার বিশ্বাসকে ‘নাড়িয়ে দিয়েছে’।
রাজনৈতিক মহলের দাবি গুজরাট বিধানসভা ভোটের কারণে বিলকিস বানুর ধর্ষকদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে। পুরোটাই ভোট ব্যাংকের কথা মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দেশটির নারী অধিকার কর্মীরা বলছেন, নারীর প্রতি বিদ্বেষ ও পুরুষতন্ত্র এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, এতটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে যে এখন ধর্ষণকেও মানুষ স্বাভাবিক চোখেই দেখছে। বিলকিস বানুর সঙ্গে যা হয়েছে, তার পরিবারের সঙ্গে যা হয়েছে, আমাদের দেশে আর এমন হোক, তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে চাই না আমরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১১৫৮
আপনার মতামত জানানঃ