পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। বিচার চেয়েও কোন প্রতিকার পাচ্ছে না ভুক্তভোগী পরিবার। অনেক ক্ষেত্রে বিচার চেয়ে মামলা দায়ের করার পর পরিবারকে দেয়া হচ্ছে হুমকি। এ কারণে পুলিশের নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো বিচার প্রত্যাশা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। পুলিশী নির্যাতনে আহত হলেও ভুক্তভোগীরা মামলা করেন না। করলেও এসব মামলার বিচার একদমই হয় না।
নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে এখন পর্যন্ত পুলিশের বিরুদ্ধে মামলার প্রকৃত তথ্য জানা না গেলেও ৩০টির মতো মামলা হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কারা হেফাজতে ৩৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৬ জনের মামলা বিচারাধীন। ১৪৬ জনের বিচার সম্পন্ন হয়েছিল।
কারা হেফাজতে দেশে ২০১৮ সালে ৭৪ জন, ২০১৯ সালে ৫৮, ২০২০ সালে ৭৫, ২০২১ সালে ৮১ ও ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছর কারা হেফাজতে মারা যাওয়া ঘটনার মধ্যে ৩৪ জনের মামলা বিচারাধীন, আর ২০ জন ছিল অভিযুক্ত।
এছাড়া মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা অন্য এক সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে কারা হেফাজতে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ছয়জন কয়েদি ও আটজন হাজতি।
২০১৮ থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কারা হেফাজতে ৩৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৬ জনের মামলা বিচারাধীন। ১৪৬ জনের বিচার সম্পন্ন হয়েছিল।
পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন নিয়ে গণমাধ্যমেও বিভিন্ন সময় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। হেফাজতে নির্যাতনে আসামি যেমন সহজে তথ্য দিয়ে থাকে তেমনি অতিরিক্ত নির্যাতনের ফলে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। অথচ সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।’
এছাড়া জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন প্রতিরোধে ২০১৩ সালে একটি আইন করা হয়। নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ এর ধারা-১৩ (১) অনুযায়ী, কেউ হেফাজতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হলে আদালতে অভিযোগ করতে পারেন। আদালতে নির্যাতন প্রমাণিত হলে ধারা-১৫ (১) অনুযায়ী শাস্তি হিসেবে ন্যূনতম পাঁচ বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেবেন। এছাড়া নির্যাতনের ফলে মৃত্যু হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন এবং অতিরিক্ত দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবেন।
সংবিধানে বিধিনিষেধ জাতিসংঘের সনদ স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে এবং নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন থাকা সত্ত্বেও হেফাজতে মৃত্যু কমছে না।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক মানুষ নির্যাতিত হয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করে সেই মামলায় এ পর্যন্ত একটা বিচার হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করলে সেটা পুলিশই তদন্ত করে। যার ফলে পুলিশের অভিযোগ পুলিশরাই এড়িয়ে যায়। তা ছাড়া পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হলে তারা প্রথমে মামলা নিতে চায় না। অনেক ক্ষেত্রে চাপে পড়ে অথবা সরকারি চাপে মামলা নেয়। কিন্তু এসব মামলার বিচার হয় না। একারণে অনেক সময় সাধারণ মানুষের অভিযোগটি পুলিশের দিকেই থাকে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, এ পর্যন্ত পুলিশের কোনো অপরাধে তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে দেখিনি। সাধারণ মানুষ যদি পুলিশের অপরাধের জন্য তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে দেখত তাহলে হয়ত পুলিশের প্রতি তারা কিছুটা আস্থা পেত। সাধারণ মানুষ দিন দিন একেবারেই পুলিশের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে কারণ পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে।
তারা বলেন, পুলিশ যদি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে না পারে এবং সেবা দিতে অক্ষমতার পরিচয় দেয় তাহলে এর দায়ভার পুলিশকে নিতে হবে। এসব বিষয়ে পুলিশকে সতর্ক থেকে আসামিদের খেয়াল রাখতে হবে এবং বিভিন্ন স্বার্থ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই সংস্থাকে বের হয়ে আসতে হবে। তবেই এই সংকট অনেকটা নিরসন হবে
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৫
আপনার মতামত জানানঃ