পশ্চিমা বিশ্ব ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা দেখেছিল গত শতকের ত্রিশের দশকে। যা ইতিহাসে ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন’ বা ‘মহামন্দা’ নামে পরিচিত। সেই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় সংঘটিত হয়েছিল, এর তুলনীয় বিপর্যয় খুব কমই দেখেছে বিশ্ব। এই মন্দায় নানারকম সমস্যা তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রের সকল স্থানীয় এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়। বেকার হয়ে পড়েন কোটি কোটি আমেরিকান। ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে যায় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা মেক্সিকান শরণার্থীদের একাংশ নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হন।
শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই ধ্বংসাত্মক প্রভাব বিস্তার করেনি এই মহামন্দা। তৎকালীন মার্কিন রাজনৈতিক আবহাওয়াও পাল্টে দেয় এটি। ব্যর্থতার দায়ভার কাঁধে নিয়ে বিদায় নিতে হয় ক্ষমতাসীন রিপাবলিকানদের। স্বাভাবিকভাবেই তারা আবার নির্বাচিত হতে পারেননি। ক্ষমতায় আসে ডেমোক্রেটরা। আর এসেই অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে কোমর বেঁধে নেমে পড়তে হয় তাদের।
যেভাবে শুরু এই বিপর্যয়ের
১৯২০ সালের পর ব্যাপক পরিবর্তন আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে। তখন দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে দেশটির অর্থনীতি। বড় শহরগুলোতে গড়ে ওঠে ব্যক্তিগত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং বড় কলকারখানা।
একই সময় মার্কিন প্রশাসন কৃষি এবং রেলখাতেও উন্নয়নের কাজ শুরু করেছিল। যার ফলে লক্ষ লক্ষ নাগরিকের স্থায়ী কর্মসংস্থান তৈরি হয়। বেড়ে যেতে থাকে তাদের আয়। নতুন নতুন কলকারখানার সঙ্গে তৈরি হয় উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, কর্পোরেট অফিস এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
কর্মসংস্থানের অভাব না থাকায় প্রায় সকল নাগরিকের হাতেই ছিল প্রচুর পরিমাণে অলস টাকা। অর্থ বিনিয়োগ করার আদর্শ জায়গা মনে করে তারা ঝুঁকে পড়েন শেয়ার বাজারে দিকে। কেউ কেউ তো নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে হয়ে ওঠেন স্থায়ী বিনিয়োগকারী। আর দিনে দিনে বাড়তে থাকে এই প্রবণতা।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, সেই সময় একজন বাবুর্চি থেকে শুরু করে একজন কারখানার মালিক—প্রায় সবাই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতেন! নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সামনে হাজার মানুষের ভিড় ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার।
১৯২৯ সালের আগস্টে এসে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজার অবস্থান করছিল এর শীর্ষবিন্দুতে। ওই বছরের গ্রীষ্মে দেশটির জাতীয় উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে এবং মার্কিন নাগরিকরা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের দিকে মনোনিবেশ করায় কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এবার শেয়ার বাজারে ঢালাও বিনিয়োগের নেতিবাচক রূপটাও ধীরে ধীরে অনুভব করতে থাকেন সবাই।
তখন একদল নাগরিক, ব্যবসার নামে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেগুলো শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন। এতে করে স্থানীয় ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকট ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে, যা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় তৎকালীন সরকার। সব মিলিয়ে এক ধরনের অনিয়ম এবং বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রের বড় শহরগুলোতে। কিন্তু এত শত সমস্যার মাঝে একদিনের জন্যেও কমেনি শেয়ারের দাম!
অতঃপর ১৯২৯ সালের অক্টোবরের শেষদিকে ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। কিছু সংখ্যক ভীতু বিনিয়োগকারী সেই সময় তাদের সব শেয়ার বিক্রি করতে থাকেন। আর তাদের মদদ দিচ্ছিলেন কিছু সংখ্যক অসাধু বিনিয়োগকারী।
শুধুমাত্র ২৪ অক্টোবর একদিনে বিক্রি হয়েছিল প্রায় ১২.৯ মিলিয়ন শেয়ার! আর এটিকে একটি সুযোগ ভেবে লক্ষ লক্ষ লোক ব্যাংক থেকে ঋণ করে শেয়ার কেনেন। গ্রেট ডিপ্রেশনের ইতিহাসে সেদিনটি চিহ্নিত হয়ে আছে ‘কালো বৃহস্পতিবার’ নামে। মূলত সেদিনই অর্থনৈতিক মহামন্দার দিকে প্রথম পা ফেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
এর চার দিন পর ২৯ অক্টোবর নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি খায়। সেদিন প্রায় ১৬ মিলিয়ন শেয়ার বিক্রি হয়েছিল। মূলত বিপর্যয় বুঝতে পেরে, একটি মহল চারদিন আগে ক্রয় করা শেয়ারগুলো বিক্রি করতে থাকে।
কিন্তু, সেটি বুঝতে পারেননি মধ্যম ও নিম্ন পর্যায়ের শেয়ারগ্রহীতারা। কম দামে পাওয়ার লোভে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেসব শেয়ার কেনেন তারা। আর এরই মাঝে শুরু হয় দরপতন। হাহাকার নেমে আসে পুরো যুক্তরাষ্ট্রে। ইতিহাসে ওই দিনটিকে ‘কালো মঙ্গলবার’ হিসেবে উল্লেখ করেন অর্থনীতিবিদরা।
গ্রেট ডিপ্রেশনের ভয়াবহতা
১৯২৯ সালের অক্টোবরের ওই দুই দিনে প্রায় ধ্বংস হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন নতুন বিনিয়োগকারীরা। আর এর প্রভাব পড়তে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের ছোট-বড় সকল ক্ষেত্রে।
কয়েকদিনের মধ্যে অর্ধেক হ্রাস পায় শিল্পকারখানার উৎপাদন। ব্যবসায় নিশ্চিত ক্ষতি বুঝতে পেরে কর্মী ছাঁটাই শুরু করে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। কোথাও কোথাও গুলিবর্ষণ করে কর্মীদের মেরে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটে। দোকানগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও, ক্রেতা খুঁজে পাচ্ছিলেন না বিক্রেতারা।
মাত্র এক বছরের মাথাতেই বেকার হয়ে যান যুক্তরাষ্ট্রের এক কোটি নাগরিক। ১৯৩১ সালে গিয়ে ঠেকে দেড় কোটিতে। রাষ্ট্রপতি হার্বার্ট হোভারের প্রশাসনও এই অবস্থায় দিশেহারা হয়ে যায়। তারা তাদের বেশকিছু বড় প্রকল্প বন্ধ করে দেয়। যার কারণে বেকার হয় আরো লক্ষ লক্ষ মানুষ। গোটা যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় রাস্তায় মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করে। সেই সময় মানুষ অভাবের তাড়নায় নিজেদের ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করতেও ক্রেতা খুঁজতেন। শুধু তাই নয়; অবস্থা এতটাই বেগতিক ছিল যে, কৃষকেরা নিজেদের ফসল সংগ্রহের সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলেন! ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কাজ খুঁজতে শুরু করেন তারা।
‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ বা মহামন্দার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পতন এবং বেকারত্ব বেড়েছে ২৫%। ‘বিষণ্নতা’ দ্রুত ইউরোপ এবং বাকি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসে এটি সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক পতন। গ্রেট ডিপ্রেশন শেষ হয় ১৯৪১ সালে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও বেকারত্বের হার কমে না।
ধনী ও দরিদ্র উভয় দেশসমূহে মহামন্দার প্রভাব ছিল বিধ্বংসী। ব্যক্তিগত আয়, কর, মুনাফা ও মূল্যমানের ব্যাপক পতন ঘটে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও ৫০% কমে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার ২৫% বেড়ে যায় এবং কিছু কিছু দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩%।
পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে মহামন্দার প্রভাব তীব্র ছিল, বিশেষ করে ভারী শিল্পের ওপর নির্ভরশীল শহরগুলোতে। অনেক দেশে নির্মাণকাজ একরকম বন্ধই ছিল। ক্ষতির মুখে পড়েছিল কৃষক সম্প্রদায় ও গ্রাম্য এলাকাসমূহ, কারণ শস্যের মূল্য ৬০%-এ নেমে এসেছিল। গুটিকয়েক চাকরির উৎসে অত্যধিক চাহিদার কারণে প্রাথমিক শিল্প, যেমন খনির কাজে চাপ সৃষ্টি হয়।
গ্রেট ডিপ্রেশনের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে বেশির ভাগ দেশেই ত্রাণ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয় এবং অনেক দেশ রাজনৈতিক বিপ্লবের সম্মুখীন হয়। ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরাচারী শাসনের কাছে গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে। বিশেষ করে ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত নাৎসি জার্মানি পাল্টে দেয় ইউরোপীয় রাজনীতির গতিপথ।
যেভাবে মহামন্দা কাটিয়ে উঠল যুক্তরাষ্ট্র
১৯৩৩ সালের মার্চে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ডেমোক্রেট নেতা ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট। ডেমোক্রেটরা পরিবর্তনের আশ্বাস দেন, যা মার্কিনিদের আকৃষ্ট করেছিল। তাই নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন ছিল অবশ্যম্ভাবী। আর দায়িত্ব নেওয়ার ১০০ কার্যদিবসের মধ্যে রুজভেল্ট প্রশাসন আশার আলো দেখাতে শুরু করে। নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্ব দূরীকরণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন শুরু হয়।
রুজভেল্ট প্রথমেই চারদিনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ দেশের সমস্ত ব্যাংক বন্ধ ঘোষণা করেন। ওই চারদিনের মধ্যে তিনি কংগ্রেসে নতুন আইন পাশ করিয়ে শিল্প, কৃষি ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে গতিশীল করার উদ্যোগ নেন।
পুরোদমে শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর কার্যক্রম। রুজভেল্ট ব্যাংকের নিয়মনীতি পরিবর্তন করেন। নিয়ম করেন শুধুমাত্র আমদানির জন্যই প্রদান করা হবে ঋণ। আর এই শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে থাকে স্থানীয় ব্যাংকগুলো।
বেশ কিছু বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছিল রুজভেল্ট প্রশাসন। প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে নাগরিকদের কর্মক্ষেত্র তৈরি করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। সে প্রকল্পের মধ্যে টেনেসি ভ্যালি অঞ্চলের বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধ, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা এবং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ছিল উল্লেখযোগ্য।
উক্ত প্রকল্পে ১৯৩৫ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত, স্থায়ীভাবে নিয়োগ পেয়েছিলেন প্রায় ৮.৫ মিলিয়ন মার্কিন নাগরিক। শুধুমাত্র একটি প্রকল্পের মাধ্যমেই রুজভেল্ট প্রশাসন অর্ধেক নাগরিকের অবস্থান পরিবর্তন করতে সক্ষম হন। এছাড়াও ডেমোক্রেটরা নেতৃত্ব কাঁধে নেওয়ার পরের ৩ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি গড়ে বেড়েছিল ৯ শতাংশ।
রুজভেল্ট প্রশাসনের সংস্কারপন্থী মনোভাবের কারণে ১৯৩৮ সাল থেকে আবারও অর্থনৈতিক-উন্নতির দেখা পায় মার্কিনিরা। রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয়ে পার্থক্য কমতে থাকে, সেই সাথে মানুষও হয়ে ওঠে সাবলম্বী। ব্যাংকগুলোও আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ায় এবং শেয়ারবাজার আগের অবস্থানে ফিরে যায়।
যদিও সেই সময়ও অর্থনৈতিক মহামন্দা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি দেশটি। কারণ ক্ষতি কাটিয়ে আগের অবস্থানে ফিরে আসতে প্রয়োজন ছিল আরো কিছু সময়ের।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ