চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে ৪০৭টি। এর মধ্যে ১৮২টি মোটরসাইকেলের দুর্ঘটনা। আবার মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৬৯ জন, যা মোট নিহতের ৩৫ দশমিক ৫০ শতাংশ।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের করা এক প্রতিবেদন এ তথ্য জানা গেছে। সোমবার (৩ অক্টোবর) এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
সূত্র মতে, ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয় প্রতিবেদনটি।
এতে বলা হয়, সেপ্টেম্বর মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪০৭টি। এতে নিহত হয়েছেন ৪৭৬ জন, আর ৭৯৪ জন আহত হয়েছেন। নিহতের মধ্যে নারী ৬২ ও শিশু ৭৭ জন। এছাড়া মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪৪ দশমিক ৭১ শতাংশ।
সড়ক দুর্ঘটনায় ১০৩ জন পথচারী নিহত হয়েছেন। যা মোট নিহতের ২১ দশমিক ৬৩ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৬৩ জন, অর্থাৎ ১৩ দশমিক ২৩ শতাংশ। এছাড়া ঢাকায় ২৯টি দুর্ঘটনায় ২৩ জন নিহত ও ৩৭ জন আহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনায় দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৬২ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। শিক্ষক নিহত হয়েছেন ১৪ জন। এছাড়া দুর্ঘটনায় ১৯-৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৩৮৪ জন, অর্থাৎ ৮০ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
একই সময়ে ৯টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৭৮ জন নিহত এবং তিনজন নিখোঁজ রয়েছেন। ২১টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত এবং ছয়জন আহত হয়েছেন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৩৪টি (৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ) জাতীয় মহাসড়কে, ১৫৮টি (৩৮ দশমিক ৮২ শতাংশ) আঞ্চলিক সড়কে, ৭৩টি (১৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ) গ্রামীণ সড়ক এবং ৩৬টি (৮ দশমিক শতাংশ) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৬টি ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ সংঘটিত হয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় গত আগস্ট মাসে ৫১৯ জন নিহত হয়েছিল। তখন গড়ে প্রতিদিন নিহত হয়েছিল ১৬ দশমিক ৭৪ জন। সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিদিন নিহত হয়েছে ১৫ দশমিক ৮৬ জন। এই হিসাবে সেপ্টেম্বর মাসে প্রাণহানি কমেছে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। তবে প্রাণহানি হ্রাসের এই মাত্রা কোনো টেকসই উন্নতির সূচক নির্দেশ করছে না।
এদিকে, গত আগস্ট মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছিল ৪৫৮টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৫১৯ জন। আহত হন ৯৬১ জন। নিহতের মধ্যে নারী ছিলেন ৬৪, শিশু ৬৯। এরমধ্যে ১৮৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন ১৭২ জন, যা মোট নিহতের ৩৩.১৪ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৯.৯৫ শতাংশ।
দুর্ঘটনায় ১০৯ জন পথচারী নিহত হয়েছিলেন, যা মোট নিহতের ২১ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছিলেন ৯৪ জন, অর্থাৎ ১৮.১১ শতাংশ। এই সময়ে ১১টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৮ জন নিহত এবং ৬ জন নিখোঁজ রয়েছেন। ২৩টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ২৪ জন নিহত এবং ৯ জন আহত হয়েছেন।
সড়ক দুর্ঘটনায় সরকারের দায় কতটা?
বাংলাদেশের সড়ক ত্রুটিপূর্ণ এবং সড়কে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল করে। চালকের দক্ষতার ঘাটতি আছে। এটা কী ব্যর্থতা নয়? এর দায় কার ওপর বর্তায়?
কাগজে-কলমে অনেক কর্মসূচি আছে। সড়ক নিরাপদ করতে প্রধানমন্ত্রীর ছয় দফা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ১৭ দফা, বিআরটিএর ১১১ দফা আছে। দেশে সড়ক আইন, নীতি, সিদ্ধান্ত অনেক হয়েছে। এখন দরকার বাস্তবায়ন। কিন্তু কদিন পরপর নতুন নতুন সিদ্ধান্ত দেয় সরকার। এর অর্থ হচ্ছে আগের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এর জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হবে না। এমনটা হলে তো কেউ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে না।
এই যেমন বুয়েটের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক বড় সমস্যা হিসেবে দেখেন, বাস মালিক বা শ্রমিকদের রাজনৈতিক প্রভাব। আর সেজন্যই সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
নিরাপদ সড়ক চাই নামের একটি সংগঠনের ফারিহা ফতেহ বলেন, “এখানে কিছু বিষয় আছে রাজনৈতিক বলতে পারেন। আর ব্যবসায়িক একটা পয়েন্ট রয়েছে। আমাদের দেশে বাসের মালিক শত শত। এই বাস চালানোর ক্ষেত্রে একটা বিষয় হচ্ছে, চালকের জন্য জমা পদ্ধতি। এজন্য চালকরা বেশি অর্থ আয় করতে রাস্তায় বাস নিয়ে প্রতিযোগিতা করে এবং উল্টা-পাল্টা করে তারা ওভারটেক করে।”
চালকের লাইসেন্স ও যানবাহনের নিবন্ধন দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তারা জানে যে চালকের চেয়ে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে। তারা এটা জেনেও চালক তৈরি না করে যানবাহন নিবন্ধন দিচ্ছে কোন বিবেচনায়? দেশে ভারী যানবাহন আছে সাড়ে তিন লাখ। আর চালক আছেন আড়াই লাখ।
দেশে পেশাদার চালক হন ‘ওস্তাদের’ (মূল চালক) সেবা করে। আবার সেই চালকেরও সংকট। উৎসবে ছুটির সময় অনেক চালক টানা ৩৬ থেকে ৪৮ ঘণ্টা রাস্তায় থাকেন। তাঁদের নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই, নিয়োগপত্র ও বেতন ঠিক নেই। ক্লান্তি-চাপে তাঁরা ঝুঁকিকে ঝুঁকি মনে করেন না। এ জন্যই যানবাহন দুর্ঘটনায় পড়ে। এর দায় বিআরটিএ এড়াতে পারে না।
আর আমাদের দেশের মহাসড়কের কোনোটাই প্রকৃত মহাসড়ক নয়। এগুলো বিপুল টাকা খরচ করে মোটাতাজা করা হয়েছে। গতি বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে, ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করা হয়নি। এ জন্য মহাসড়কের মোড়ে মোড়ে বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। উচ্চগতি আর ধীরগতির যান একসঙ্গে চলে। মহাসড়ক ঘিরে শত শত বাজার গড়ে উঠেছে।
শুধু উন্নত দেশ নয়, ভারতের হরিয়ানা রাজ্যও দুর্ঘটনা কমিয়ে এনেছে। এর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হয়, চাপের ঊর্ধ্বে থেকে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হয়। বাংলাদেশে মহাসড়ক থেকে নছিমন, করিমন, ভটভটি তোলা যাচ্ছে না। কারণ, এর সঙ্গে রাজনীতি জড়িত আছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনীতি নয়, বিজ্ঞানকে প্রাধান্য দিতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৪০
আপনার মতামত জানানঃ