ব্যাংকে একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে সমালোচনার মধ্যেও ‘নাবিল গ্রুপ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে পর্যাপ্ত নথিপত্র ও জামানত ছাড়াই প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে তিনটি ব্যাংক। একজন গ্রাহককে সর্বোচ্চ যত টাকা ঋণ দেয়া যায়, তার সীমাও লঙ্ঘন করেছে ব্যাংক তিনটি।
সূত্র মতে, ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা নাবিল ফিড মিলস ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে ৩ হাজার ১০০ কোটি ও গুলশান শাখা নাবিল গ্রেইন ক্রপসের নামে ৯৫০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা দিয়েছে নাবিল নব ফুড ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান, নাবিল ফিড মিলস এবং শিমুল এন্টারপ্রাইজের নামে। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার ১২০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন
বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে এই ঋণ ঝুঁকি তৈরি করবে। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতিবেদনে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে এই ঋণ ব্যাংকের পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে বেনামি ঋণ হতে পারে।
ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো কতটা উদার ছিল, তা উঠে এসেছে এই প্রতিবেদনে। গ্রুপের একটি কোম্পানির বর্তমাণ ঋণ আছে সাড়ে আট লাখ টাকা। সেই কোম্পানিকে দেয়া হয়েছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। এই টাকা ব্যবহারের সক্ষমতা আছে কি না, সেটিও যাচাই করা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অফ অফসাইট সুপারভিশন বিভাগ।
এদিকে, নতুন একটি প্রতিষ্ঠানকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেয়া হলেও পর্যাপ্ত নথি নেই বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, অধিকাংশ ঋণেই কোনো ধরনের জামানত রাখা হয়নি। এই ঋণের অর্থ কোথায় ব্যবহার হবে তাও পরিষ্কার নয়। এ ছাড়া নতুন একটি গ্রুপকে এত টাকা ঋণ দেয়া হলেও তার পর্যাপ্ত নথি সংরক্ষণ করা হয়নি।
গ্রুপের একটি কোম্পানিকে ৯৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে, কিন্তু সর্বশেষ সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) রিপোর্ট অনুসারে, এর আগে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ওই কোম্পানির ঋণ রয়েছে মাত্র সাড়ে ৮ লাখ টাকা। ফলে এই পরিমাণ অর্থ ব্যবহারের সক্ষমতা রয়েছে কি না, তাও যাচাই করা হয়নি।
এই ঋণ ব্যাংকের পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে বেনামি ঋণ কি না, সেই সন্দেহ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে।
বিশেষ নিরীক্ষার সুপারিশ প্রতিবেদনে বলা হয়, এত বড় অঙ্কের ঋণের বিপরীতে কোনো জামানত নেয়া হয়নি। তিন মাসে এলসি কমিশন মাত্র দশমিক ১৫ শতাংশ। গ্যারান্টির ক্ষেত্রে নাবিল ফার্মের করপোরেট গ্যারান্টি গ্রহণ করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৪৮১তম বোর্ড মিটিংয়ে ঋণ অনুমোদন দেয়া হলেও ৪৮২ এবং ৪৮৩তম বোর্ড সভায় শর্ত শিথিল করা হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গ্যারান্টির ক্ষেত্রে সব পরিচালক এবং তাদের স্বামী/স্ত্রীর গ্যারান্টি ছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে শর্ত শিথিল করে শুধু পরিচালকদের গ্যারান্টি রাখা হয়।
আমানত সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বলা হয়, নিজ নামে অথবা রেফারেন্সে অন্যদের নামে প্রাথমিকভাবে ২০০ কোটি এবং পরবর্তী সময়ে আমানত ৬০০ কোটি টাকায় উন্নীত করতে হবে, কিন্তু পরে তা শিথিল করে বলা হয়, পর্যাপ্ত আমানত রাখতে হবে। এই পর্যাপ্তের কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, একটি নতুন ঋণের ক্ষেত্রে কোনো বিবেচনায় শর্ত শিথিল করা হলো তা জানা জরুরি। এ ছাড়া গ্রাহক বেনামে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান কি না, সেটিও যাচাই করতে হবে। কোন বিবেচনায় নতুন একজন গ্রাহককে তিন ব্যাংক এত বিপুল পরিমাণ ঋণ দিয়েছে তা যাচাই করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে ফোর্সড (বাধ্যতামূলক) ঋণ আদায় অগ্রগতি অবহিত করা, কোন বিবেচনায় এই ঋণ দেয়া হলো, তার ব্যাখ্যা এবং বিস্তারিত কাগজপত্র জমা দেয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, গুলশান শাখার নতুন গ্রাহক নাবিল গ্রেইন ক্রপসের অনুকূলে ৯৫০ কোটি টাকা নন ফান্ডেড ঋণ দেয়া হয়েছে। ব্যাংকের নীতিমালা অনুসারে এই ঋণে ২৩০ কোটি টাকা জামানত হওয়ার কথা। ঋণের শর্তে ১১০ কোটি টাকার আমানত অথবা লিয়েন থাকার কথা বলা হয়েছে। এক জায়গায় বলা আছে, কৃষিপণ্য আমদানি ও বিপণনের জন্য এই অর্থ ব্যবহার হবে, কিন্তু সর্বশেষ সিআইবি প্রতিবেদন অনুসারে বিভিন্ন ব্যাংকে ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকের এক্সপোজার মাত্র সাড়ে ৮ লাখ টাকা।
প্রকল্প ঋণ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গ্রাহক একেবারে নতুন। ফলে সম্পূর্ণ নতুন একজন গ্রাহককে বাণিজ্যের জন্য এই পরিমাণ ঋণ দেয়া হলো। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের বড় ব্যবসা পরিচালনার দক্ষতা এবং অর্থের সঠিক ব্যবহার হয়েছে কি না, তা যাচাই করা দরকার।
নাবিল ফিড মিলসের নামে নতুন করে ৭০০ কোটি টাকাসহ মোট ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা অনুমোদন দিয়েছে ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা, কিন্তু নাবিল গ্রেইন ক্রপস কোনো গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সন্দেহ, এটিও গ্রুপের প্রতিষ্ঠান। ফলে একক কোনো গ্রুপকে ঋণ দেয়া সংক্রান্ত যে আইন রয়েছে, এটি তার লঙ্ঘন।
একক প্রতিষ্ঠানের ঋণসীমা লঙ্ঘন
কোনো ব্যাংক তার মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ কোনো কোম্পানি বা গ্রুপকে দিতে পারবে না। এই ঋণ ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড উভয় মিলেই। এ ক্ষেত্রে ফান্ডেড বা সরাসরি ঋণ হবে ১৫ শতাংশ, যা বড় ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হবে। আগে সুদসহ ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ শতাংশ।
নন-ফান্ডেড ঋণে রপ্তানি খাতের ক্ষেত্রে ১০০ টাকার ঋণকে ৫০ টাকা এবং বিদ্যুৎ খাতের ক্ষেত্রে ১০০ টাকার ঋণকে ২৫ টাকা হিসেবে গণনা করতে হবে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এমন নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে বলে উল্লেখ করা হয়।
গত জুন শেষে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের মোট মূলধনের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৩০ কোটি টাকা। এর ২৫ শতাংশ হিসেবে ব্যাংকটি একটি গ্রুপকে সর্বোচ্চ দিতে পারবে ২ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। কিন্তু তারা দিচ্ছে এর চেয়ে দেড় হাজার কোটি টাকা বেশি।
একই সময়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মূলধন ছিল তিন হাজার ৭১৮ কোটি টাকা। এ হিসাবে ব্যাংকটি নাবিল গ্রুপকে সর্বোচ্চ ঋণ দিতে পারবে ৯৩০ কোটি টাকার মতো। তারা বেশি দিচ্ছে ২৭০ কোটি টাকা।
জুন শেষে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মূলধন ছিল তিন হাজার ২৬০ কোটি টাকা। এ হিসাবে ব্যাংকটি গ্রুপটিকে ঋণ দিতে পারে সর্বোচ্চ ৮১৪ কোটি টাকা। তারা বেশি দিচ্ছে ২৯৬ কোটি টাকা।
কী বলছে নাবিল গ্রুপ?
নাবিল গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন মো. জাহান বক্স মণ্ডল। এর পরিচালক ইসরাত জাহান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম এবং উপপরিচালক মো. মামুনুর রশীদ।
নাবিল গ্রুপের ওয়েবসাইটে গ্রুপটির ১৭টি প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাবিল নব ফুড, ফ্লাওয়ার মিল, ফিড মিল, অটো রাইস মিল, ডাল মিল, কনজ্যুমার প্রোডাক্টস, নাবিল ফার্ম, ক্যাটল ফার্ম ও নাবিল ট্রান্সপোর্ট।
ওয়েবসাইটে গ্রুপের পণ্য হিসেবে কেবল ছয়টির কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো চাল, আটা, ময়দা, সুজি, ডাল ও পশুখাদ্য।
গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সব কাগজপত্র রয়েছে। কোনো ঘাটতি নেই।’
জামানত ছাড়া ঋণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শতভাগ বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী ইনভেস্টমেন্ট হয়েছে। উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান আমরা। এখানে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ কাজ করে। নিয়মের মধ্যেই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঋণ ছাড় করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি তদন্ত করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে সব ঠিক আছে।’
একক ঋণসীমা মানার বিষয়ে প্রশ্ন করলে এমডি বলেন, ‘অবশ্যই, নিয়ম মেনেই তিন ব্যাংক ঋণ দিয়েছে।’
এসডব্লিউ/এসএস/১১৩০
আপনার মতামত জানানঃ