সাম্প্রতিকালে সান জোসে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা। সূত্র মতে, বর্তমান বাজার মূল্যে কয়েক বিলিয়ন ডলারের স্বর্ণ বহন করেছিল জাহাজটি। তবে ইংরেজদের আক্রমণের মুখে জাহাজটি ডুবে যায়। ইতিহাসবিদরা বলেন, ওই সময় ইউরোপিয়ানদের মধ্যে তুমুল বিরোধ ছিল সম্পদ নিয়ে। সমুদ্র পথে ডাকাতি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। আজ আমরা সেই ঐতিহাসিক সান জোসে ডাকাতি সম্পর্কে জানবো।
১৭০৪ সালের ৮ জুন কলম্বিয়ার কার্টেজেনা বন্দরের কাছাকাছি এই ঘটনা ঘটে। তবে এর প্রকৃত ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। আধুনিক সময়ের ইতিহাসবিদরা অনেকগুলো নথি একত্র করে সান জোসে ঘটনার কিছু বাস্তব গল্প তুলে ধরেছেন। এই যুদ্ধের বিবরণ মতে জানা যায়, ক্যারিবিয়ান সাগরে একটি স্প্যানিশ ধন-সম্পদ বোঝাই জাহাজ অন্যত্র যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেকালে রাজা পঞ্চম ফিলিপের শাসনামলে স্পেন ও স্প্যানিশ উপনিবেশিক অঞ্চলে স্প্যানিশ ট্রেজার ফ্লিট পরিচালিত হতো। ওই বাণিজ্যিক কাফেলাতে একাধিক জাহাজের পাশাপাশি থাকতো শুধু মালামাল বহনের জাহাজও।
যাইহোক, একটি জাহাজ স্পেন থেকে যাত্রা করে ১৭০৬ সালে কার্টেজেনাতে পৌঁছায়। ওই জাহাজটি মূলত পানামার পূর্ব উপকূলে অবস্থিত পোর্টোবেলো মেলায় পেরুর ভাইসারয়্যালিটির ব্যবসায়ীদের সাথে পণ্য বিনিময় করতো। জাহাজটি পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় পেরুর ব্যবসায়ীরা ভেবেছিল ইংরেজরা এটিকে লুটপাট করেছিল। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ১ বছর দেরি করে জাহাজটি সেখানে পৌঁছায়। ১৭০৮ সালের মে মাসে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। স্প্যানিশরা পেরুর ওই মেলা থেকে বিলিয়ন ডলার মূল্যের সোনা, রৌপ্য, গয়না এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র সংগ্রহ করে। পোর্টোবেলো থেকে ধন সম্পদ নিয়ে কার্টেজেনার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় স্প্যানিশরা।
হাভানায় যাত্রার আগে এটিই ছিল তাদের শেষ বিরতি। সেখানে তারা স্প্যানিশ বহরের অবশিষ্ট অংশের সাথে মিলিত হওয়ার কথা ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল হারিকেন মৌসুমের আগেই আটলান্টিক পাড়ি দেয়া। সম্মিলিত নৌবহরটির দুটি বড় জাহাজে সিংহভাগ স্বর্ণ লোড করা হয়েছিল। একটি জাহাজ ছিল সান জোসে এবং অন্যটি ছিল সান জোয়াকিন। অন্য একটি ছোট সান্তা ক্রুজ জাহাজে অল্প পরিমাণ সম্পদ রাখা হয়। এই তিন জাহাজের সঙ্গে ছিলেন এক ডজন নাবিক ও তাদের অসংখ্য সহকারী। তাদের বেশিরভাগই ছিলেন নিরস্ত্র। আর জাহাজে সংরক্ষিত ছিল ছোট অস্ত্র ও গোলাবারুদ।
এরপর ৮ জুন তারিখে কার্টেজেনা উপকূলের কাছাকাছি পৌঁছায় স্প্যানিশ ওই নৌবহর। এদিকে তাদের জন্য কয়েক মাস ধরে দলবল নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন ইংরেজ কমান্ডার চার্লস ওয়েগা। চারটি শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ এবং একটি কামান বোঝাই জাহাজ নিয়ে গঠিত বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ওয়েগার। দেখা মাত্রই দু’পক্ষের জাহাজ একে অপরের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। সান জোসে এবং ওয়েজারস এক্সপিডিশন স্কোয়ার অফ পরস্পর মুখোমুখি হয়। অন্যদিকে সান জোয়াকিনের মুখোমুখি হয় ইংরেজ কিংস্টন সান জাহাজ। সন্ধ্যা গড়িয়ে মাঝ রাতে যুদ্ধ আরও বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে সান জোয়াকিন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে সরে যায়। ইংরেজরা তাকে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলে। এটি ততক্ষণে অক্ষত অবস্থায় ফের কার্টেজেনায় ফিরে আসে। এর সঙ্গে অল্প ধন-সম্পদ থাকা ছোট জাহাজগুলোও বন্দরে ফিরে আসে।
অন্যদিকে, সান জোসে তখনও সমুদ্রের একাই লড়াই করে যাচ্ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে। এক পর্যায়ে ইংরেজ জাহাজ যুদ্ধ থেকে সরে অন্যত্র চলে যায়। তবে টানা এক ঘণ্টার কামান হামলার শিকার হয়ে সান জোসে জাহাজটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক জীবিত প্রত্যক্ষদর্শীর মতে জাহাজটিতে আগুন লাগে এবং এটি ডুবে যায়। প্রায় ৬০০ জন লোক তখন ওই জাহাজে কর্মরত ছিলেন। যারা বেঁচে ছিলেন তারা কিছুই মনে রাখতে পারেননি।
অন্যদিকে, জাহাজটিতে মজুদ থাকা স্বর্ণ ও অন্যান্য সম্পদ পানিতে তলিয়ে যায়। এতো ব্যয়বহুল যুদ্ধে শেষে ইংরেজদের অর্জনের পাল্লায় তেমন কিছুই উঠেনি। সান্তা ক্রুজ জাহাজ থেকে কয়েকটি রূপার টুকরা পেয়েছিল তারা। ইতিহাসবিদরা বলেন, ওই যুদ্ধে ইংরেজরা এক টুকরো স্বর্ণও লুট করতে পারেনি। এদিকে পালিয়ে যাওয়া সান জোয়াকিনকে খুঁজে না পাওয়ায় ইংরেজ জাহাজ কিংস্টন এবং পোর্টল্যান্ডের নাবিকদের বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল জারি করা হয়েছিল। শেষে দুই দেশের পক্ষ থেকেই এই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতিকে ঐতিহাসিক ক্ষতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
কয়েক শত বছর ধরে সান জোসের নিমজ্জিত জাহাজ নিয়ে গল্পকথা প্রচলিত ছিল। ইতিহাসবিদরা ওই জাহাজের ধ্বংসাবশেষকে জাহাজ ধ্বংসের পবিত্র কঙ্কাল বলে আখ্যায়িত করেন। সমুদ্রের প্রায় ৩ হাজার ফুট নিচে পড়ে ছিল এটি। বিংশ শতকে সমুদ্রের তলদেশে পৌঁছানোর জন্য প্রচলিত প্রযুক্তি এতটা ভালো ছিল না যে গবেষকরা এগুলো নিয়ে বিস্তর অনুসন্ধান করবে। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে আমেরিকান একদল বিনিয়োগকারী সান জোসে অনুসন্ধানের জন্য অর্থ বিনিয়োগ করে। এটি ছিল ধনসম্পদে পরিপূর্ণ জাহাজটি অনুসন্ধানে প্রথম কোনো আধুনিক অভিযান। আর্মাডা কোম্পানিকে কলম্বিয়ার সমুদ্রসীমায় কাজ চালানোর অনুমতি দেয়া হয় ওই বছর। এক বছর অনুসন্ধানের পরে, তারা ধ্বংসাবশেষ সনাক্তের দাবি করে।
পরে কলম্বিয়া সরকারকে সান জোসের ধন-সম্পদ ভাগাভাগি নিয়ে অনুসন্ধানকারীদের সাথে আলোচনায় বসে। প্রাথমিকভাবে তারা সরকারকে ৬৫ শতাংশ দিয়ে নিজেরা ৩৫ শতাংশ নিতে একমত হয়। কিন্তু কিছুদিন পরে ওই জাহাজটি উদ্ধারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কলম্বিয়া সরকার। দেশটির পার্লামেন্ট তখন চুক্তিটি প্রত্যাখ্যান করে। নতুন চুক্তি অনুযায়ী ৯৭.২৫ শতাংশ দাবি করে দেশটির পার্লামেন্ট। যদিও অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান এসএসএ কলম্বিয়ার আদালতে মামলা করে এবং ৫০ শতাংশ হারে ভাগাভাগির রায় পায়। কিন্তু আদালতের রায় প্রত্যাখ্যান করে পার্লামেন্ট। এসএসএ পরে মার্কিন ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার আদালতে মামলা করে এবং হেরে যায়। এই ঘটনায় শেষ পর্যন্ত একটি কানাকড়িও পায়নি মার্কিন বিনিয়োগকারীরা।
২০১৫ সালে উডস হোল ওশানোগ্রাফিক ইনস্টিটিউটের গবেষকদের একটি দল তাদের তৈরি রোবটিক সাবমেরিন দিয়ে ধ্বংসাবশেষটি সনাক্ত করে। দেশটির তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ওই বছরই সান জোসে আবিষ্কারের ঘোষণা দেন। পরে আর বিস্তর গবেষণার অনুমতি দেয়া হয়নি তাদের। যাইহোক, দেশটির রাজনীতির জন্য ওই জাহাজ এখন খুবই বড় ভূমিকা পালন করছে। ইতোমধ্যেই স্পেন ওই জাহাজের মালিকানা দাবি করেছে। তবে কলম্বিয়া জানিয়েছে এটি তাদের সমুদ্রসীমায় অবস্থান করছে বিধায় এর উপর তাদের অধিকার সবার আগে।
অন্যদিকে, কলম্বিয়ার রাষ্ট্রপতি জানিয়েছেন অতীতে ওই জাহাজ উদ্ধারে যতো পরিকল্পনা এবং চুক্তি ছিল সব বাতিল বলে গণ্য হবে। এদিকে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, নিজ ভূখণ্ডে থাকা যে কোনো মূল্যবান গুপ্তধনই দেশের সম্পদ হিসেবে গণ্য করা উচিত।
সাম্প্রতিককালে কয়েকটি অনুসন্ধানী গ্রুপ ওই জাহাজের ভিডিও প্রকাশ করেছে। ওই জাহাজটির আশেপাশে এখনও স্বর্ণ, রূপা এবং আরও মূল্যবান সম্পদ জ্বল জ্বল করতে দেখা যাচ্ছে। অনেকে মনে করেন, ভূ-রাজনীতিক সংকট থেকে দূরে থাকতে কলম্বিয়া সরকার জাহাজটি উদ্ধারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে। যাই হোক, সম্পদ নিয়ে মানুষের যুদ্ধ ও লালসার তিনশত বছর পরেও সম্পদ কিংবা এর নির্দোষ বাহন কোনোটাই উদ্ধার করতে পারেনি কেউ। বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য এটি একটি উদাহরণ বলা যায়।
এসডব্লিউ/এসএস/২০২০
আপনার মতামত জানানঃ