ভারতের কট্টর মুসলিমবিরোধী সংগঠন বলে পরিচিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএসের শীর্ষ নেতৃত্ব ইদানীং মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রশংসা শুরু করেছেন। এমনকি মসজিদে গিয়েও মুসলিম নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে বৈঠক করতে দেখা গেছে সংঘের প্রধান মোহন ভগবতকে। বর্তমানে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক অসংহতি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা গেছে তাকে। সংঘের এমন আচরণকে সন্দেহের চোখে দেখছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা।
মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রশংসা, নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করলেও আসামে অসমিয়া মুসলমানদের প্রশংসার পাশাপাশি বাঙালি মুসলমানদের বিদেশি বা বাংলাদেশি বলে বিভাজনের রেখা টানার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও আরএসএস মদদপুষ্ট বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে।
ভারতীয় পরিসরে আসাম এখন ক্ষুদ্র এক রাজ্য। কিন্তু সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে হিমন্তবিশ্ব শর্মার সর্বভারতীয় অবস্থান উল্টো। তিনি আরএসএস পরিবারে সামনের সারির একজন। সফলতায় এবং বুদ্ধিমত্তায় নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ এবং যোগী আদিত্যনাথের পরই হিন্দুত্ববাদী শিবিরে তার অবস্থান। নিজের এই অবস্থানকে ধরে রাখতে এবং এগিয়ে নিতে হলে আসামে তাকে নিরঙ্কুশ অবস্থা তৈরি করতেই হবে। আসামের রাজনীতিতে অ-বিজেপি অসমিয়া ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সঙ্গে বাংলাভাষী মুসলমান ভোটের যৌথতা তার জন্য এক দূরবর্তী সমস্যা। সেই বিবেচনাতেই এগিয়ে যাচ্ছেন বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।
পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনুমান, ভারতের বিশালসংখ্যক মুসলিম ভোটব্যাংকের কথা মাথায় রেখেই বিজেপি মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন চাইছে। তাই পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া বা পিএফআইয়ের মতো মুসলিম সংগঠনের নেতাদের গ্রেপ্তার করে সংগঠনটিকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের একাংশের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী নেতাদের দহরম-মহরম বাড়ছে।
গত আগস্টে আরএসএস সংঘের প্রধান মোহন ভগবত পাঁচজন মুসলিম বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে বৈঠক করে গোটা দেশকে অবাক করে মুসলিমদের প্রতি সহিষ্ণুতার বার্তা দেন। অতি সম্প্রতি দিল্লির একটি মসজিদে বৈঠক করেন অল ইন্ডিয়া ইমাম অর্গানাইজেশনের প্রধান ইমাম উমর আহমেদ ইলিয়াসীর সঙ্গে। সেখান থেকেও মৈত্রী বার্তা পৌঁছে যায় মুসলিম সমাজের কাছে। শুধু তাই নয়, নিজেদের অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতার পরিচয় দেওয়ার পাশাপাশি কংগ্রেসশাসিত ছত্তিশগড়ে মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেলের আমন্ত্রণেও তার রাজ্যে হাজির হন।
পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া বা পিএফআইয়ের মতো মুসলিম সংগঠনের নেতাদের গ্রেপ্তার করে সংগঠনটিকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের একাংশের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী নেতাদের দহরম-মহরম বাড়ছে।
এর আগে প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে নিজেদের সদর দপ্তরে নিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক সহিষ্ণুতারও পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করে আরএসএস। বাংলাদেশের প্রতিবেশী আসামে রীতিমতো অসমিয়া মুসলিমদের আলাদা মর্যাদা দিচ্ছে সরকার। সেখানে বাঙালি ও অসমিয়া মুসলমানদের মধ্যে বিভাজনের রাজনীতি স্পষ্ট।
আসামের মুসলমান মানেই চিরস্থায়ী চ্যালেঞ্জে থাকা এক জনগোষ্ঠী। ‘বিদেশি খেদা’ আন্দোলনের দুঃসহ স্মৃতির পর ‘নাগরিকপঞ্জি’–এর সংকট পেরোতেই এখন তাদের নতুন চ্যালেঞ্জে ফেলা হলো।
সম্প্রতি রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আসামের মুসলমান সম্প্রদারের ৫টি উপধারাকে ‘ভূমিপুত্র’–এর স্বীকৃতি দেওয়া হবে। আপাতদৃষ্টিতে এই সিদ্ধান্তকে বেশ নিরীহ এবং অভিনন্দনযোগ্য মনে হলেও স্থানীয় মুসলমানরা এতে সূদূরপ্রসারী এক বিপদের আভাস পাচ্ছেন।
ভারতে মুসলমান জনসংখ্যার ৬ দশমিক ২ ভাগ থাকে আসামে। সংখ্যায় এক কোটির সামান্য বেশি। সর্বভারতীয় লোকসংখ্যার বিচারে এই জনসংখ্যা অতি নগণ্য দশমিক ৮৮ ভাগ মাত্র (.৮৮%)। কিন্তু এই মুসলমানদের নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা এবং নজরদারির শেষ নেই। প্রতিনিয়ত তাদের খবর হিসেবে তুলে আনা হয়। বিশেষ করে এমন ‘উদ্বেগ’ প্রায়ই ছড়াচ্ছে—রাজ্যটি মুসলমান-প্রধান হয়ে যাচ্ছে! অথচ এই রাজ্যের ৩৩টি জেলার চার ভাগের তিন ভাগেই মুসলমান সংখ্যালঘু। পুরো রাজ্যে তাদের হিস্যা এক–তৃতীয়াংশ মাত্র (৩৪ দশমিক ২২ শতাংশ)। অর্থনৈতিক বিবেচনাতেও তাদের বড় অংশ গণহারে নিম্নবর্গ বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলাভাষীরা।
আর্থসামাজিক বঞ্চনা এবং ধর্মীয় বৈরিতার শিকার যেকোনো জনগোষ্ঠী যেকোনো দেশে সচরাচর এক কাতারে থাকতে চায়। আসামে মুসলমানদের মাঝেও এ রকম প্রবণতা আছে। কিন্তু ভোটের অঙ্কে সেটা অসমিয়া প্রভাবশালীদের জন্য বিপত্তিমূলক। ফলে মুসলমান ভোটব্যাংককে বিভক্ত করার একটা পুরোনো প্রচেষ্টা জারি ছিল বহুকাল থেকে। সম্প্রতি তা বেশ পরিণত আদল পেল রাজ্য সরকারের এক ঘোষণায়।
বামপন্থীদের মতে, আরএসএস হলো বিজেপির আসল চালিকাশক্তি। গোটা দেশে হিন্দুত্ববাদীদের দৌরাত্ম্যের সঙ্গে যুক্ত আরএসএসের সদস্যরাই। প্রবীণ সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর মতে, হাতির যেমন দেখানোর ও খাওয়ার দাঁত আলাদা থাকে, আরএসএসেরও ঠিক তাই। কংগ্রেস নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরীর মতে, জাতির জনক গান্ধীজির হত্যাকারীদের রক্তের দাগ লেগে রয়েছে আরএসএসের গায়ে।
গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক অশান্তির জন্য তিনি আরএসএস-বিজেপিকেই দায়ী করেন। সম্প্রতি কলকাতায় দুই প্রয়াত আরএসএস নেতা কেশব রাও দীক্ষিত ও শ্যামলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মরণসভায় মোহন ভাগবত বলেন, ‘গোটা বিশ্বের মানবিকতার জন্য ভারতীয় হিন্দুরা রোল মডেল হবে। সংঘের স্বয়ংসেবকদের সেই রোল মডেল হতে হবে। ধীরে ধীরে মানুষ সংঘের স্বয়ংসেবকদের অনুকরণ করতে শুরু করেছে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৬
আপনার মতামত জানানঃ