রাশিয়ার এক সেনা অফিসার স্ট্যানিস্লাভ পেট্রোভ। ৩০ বছর আগে পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। যদিও পেট্রোভ নিজেকে ‘হিরো’ মনে করেন না। তিনি যা করেছিলেন তা তার কর্তব্য ছিল বলেই মনে করেন তিনি।
সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার পর পেট্রোভ মস্কোর কাছে একটি ছোট শহরে বসবাস করতে শুরু করেন। ২০১৭ সালে ৭৭ বছরে সেখানেই মারা যান তিনি।
জীবনকে অর্থবহ করে গেছেন তিনি। পৃথিবীকে সম্ভাব্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে কাজ করেছেন। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন, ধ্বংসের হাত থেকে। একটি সম্ভাব্য পারমাণবিক বিপর্যয়ের হাত থেকে বিশ্বকে বাঁচিয়ে মানুষের চোখে ‘হিরো’ হয়ে উঠেছিলেন পেট্রোভ।
১৯৮৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। আমেরিকা এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে তখন ঠান্ডা যুদ্ধের আবহ। সেই সময় এই দু’দেশের মধ্যে কোনও ছোটখাটো বিষয়ে খুটখাট লাগলেও সারা বিশ্বে তটস্থ থাকত, এই বুঝি পরমাণু যুদ্ধ শুরু হয়। তত দিনে হিরোশিমা-নাগাসাকি বিশ্বকে চিনিয়ে দিয়েছিল পরমাণু বিস্ফোরণের ভয়াবহতা।
২৬ সেপ্টেম্বর ভোরবেলা সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনীর কাছে কম্পিউটারে সতর্কবার্তা আসে, আমেরিকা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে উড়ে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে ক্ষেপণাস্ত্র।
সোভিয়েত ইউনিয়ন এ রকম পরিস্থিতির জন্য আগে থেকেই তৈরি ছিল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, আমেরিকার তরফ থেকে তাদের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে এলে তারাও পাল্টা পরমাণু হামলা চালাবে।
যখন এই সঙ্কেত আসে, সেই সময়ে ঐ অফিসের ডিউটি অফিসার ছিলেন পেট্রোভ। শত্রুদেশের দিক থেকে কোনও ক্ষেপণাস্ত্র তাদের দিকে উড়ে আসছে কি না, তা দেখাই তার কাজ ছিল। কম্পিউটারের পর্দায় এই ধরনের কোনও তথ্য আসা মাত্রই ডিউটি অফিসারদের কাজ ছিল এই বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তাদের জানানো।
কম্পিউটারের পর্দায় ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে আসার তথ্য দেখেও পেট্রোভ ঠিক করেন তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্তাদের কাছে এই বিষয়ে কিছু জানাবেন না। কারণ এই তথ্য কর্তৃপক্ষকে জানানোর পর কী হতে পারে সে বিষয়ে একটু হলেও ওয়াকিবহাল ছিলেন পেট্রোভ। আর সেই কারণেই তিনি ঠিক করেন কিছু জানাবেন না।
উল্টে তাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান যে, আমেরিকা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করতে পারে এ রকম কোনও তথ্য তার কাছে নেই৷
পেট্রোভ জানতেন, কর্তৃপক্ষকে আমেরিকার ক্ষেপণাস্ত্রের বিষয়ে কিছু না জানিয়ে তিনি নিয়ম লঙ্ঘন এবং কর্তব্যের প্রতি অবহেলা করছেন। এ-ও জানতেন, পরে সামরিক এবং রাজনৈতিক নেতারা এই বিষয়ে জানতে পারলে তার মৃত্যুদণ্ডের সাজাও হতে পারে।
পেট্রোভ বুঝতে পারেন, ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কোনও খবর সোভিয়েত দেশের সামরিক বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে জানালে ১৯৮৩ সালের রাজনৈতিক আবহে এর ফল মারাত্মক হতে পারে। অনেক উন্নত দেশ পারমাণবিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। আর সেই কারণেই তিনি এই বিষয়ে চুপ করে থাকার সিদ্ধান্ত নেন।
পেট্রোভের সামনেই সাইরেন বেজে ওঠে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমেরিকা থেকে প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে আসার সঙ্কেত আসে পেট্রোভের কাছে। এই সঙ্কেতে কোনও ভুল থাকতে পারে না বলেও কম্পিউটার তাকে সতর্ক করে।
২৮টি নিরাপত্তা স্তর পেরোলে তবে পেট্রোভের কম্পিউটারে হামলার সঙ্কেত আসত। তাই তিনি এক প্রকার নিশ্চিত ছিলেন যে এই হামলা হচ্ছেই।
এর পর আমেরিকা থেকে একে একে আরও চারটি ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে আসার সঙ্কেত আসে পেট্রোভের কম্পিউটারে। কম্পিউটার বলছিল, এর মধ্যে একটি ক্ষেপণাস্ত্র নাকি উড়ে আসছিল পেট্রোভের দিকেই।
পেট্রোভ বুঝতে পেরেছিলেন মৃত্যু আসন্ন। একের পর এক সিগারেট খেতে থাকেন তিনি। দুই-এক বার পেট্রোভের এমনো মনে হয়, দেরি না করে এখনই এ বিষয়ে তার ঊর্ধ্বতনদের জানানো উচিত।
পেট্রোভের মতো অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞই আমেরিকার ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনীর নড়াচড়ার দিকে নজর রাখছিলেন। হামলার বিষয়ে নিশ্চিত হতে তাদের ইনিয়েবিনিয়ে জিজ্ঞাসা করেন পেট্রোভ। কিন্তু পেট্রোভকে চমকে দিয়ে তারা জানান, তাদের কাছে হামলার বিষয়ে কোনও তথ্য নেই।
তার অফিসের বাকিদের এই সঙ্কেত নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে পেট্রোভ বুঝতে পারেন, যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য কম্পিউটারে ভুল সঙ্কেত দেখাচ্ছে। পেট্রোভ এ-ও জানতেন, তিনি যদি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা জানান, তা হলে কিছু ক্ষণের মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক বোমা আছড়ে পড়ত আমেরিকায়।
২৩ মিনিট উৎকন্ঠার সঙ্গে কাটানোর পর পেট্রোভ বুঝতে পারেন, আমেরিকার তরফে সত্যিই কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়নি। তার কাছে ভুল সঙ্কেত এসেছিল।
পেট্রোভের মতে, তার দলে তিনিই একমাত্র অফিসার ছিলেন যার কাছে নৈতিক শিক্ষা সব থেকে বেশি ছিল। বাকি সকলেই পেশাদার সেনা ছিলেন। তাদের কেবলমাত্র বিনা বাক্যব্যয়ে আদেশ পালন করার কথা শেখানো হয়েছিল।
তার জায়গায় সে দিন অন্য কোনো অফিসার থাকলে পরমাণু হামলা নিশ্চিত ছিল বলেও নিশ্চিত ছিলেন পেট্রোভ। এই ঘটনার কথা বেশি দিন চাপা থাকেনি। পেট্রোভের নেয়া সিদ্ধান্তের জন্য তিনি প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছিলেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৪৫
আপনার মতামত জানানঃ