টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার বাঁশতৈল পুলিশ ফাঁড়িতে লেবু মিয়া (৫০) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) ভোরে এ ঘটনা ঘটে। পুলিশের দাবি তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তবে স্বজনদের অভিযোগ, পুলিশের নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে।
লেবুর পরিবার অভিযোগ করেছে, তাকে বাঁশতৈল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সাখাওয়াত হোসেনসহ পুলিশ সদস্যরা নির্যাতন করে মেরে ফেলেছেন। বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য লাশ আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তারা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার ১৩ নম্বর বাঁশতৈল ইউনিয়নের বাঁশতৈল পশ্চিমপাড়া গ্রাম থেকে এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। মৃতের নাম সখিনা বেগম। তিনি স্বামী পরিত্যক্তা ছিলেন। তার সাবেক স্বামীর নাম মফিজ উদ্দিন। ৮-১০ বছর আগে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হলে বাঁশতৈল পশ্চিমপাড়া গ্রামে এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে সখিনা বসবাস করতেন। ছেলে মালেশিয়া প্রবাসী। তার দুই মেয়ে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় ছেলের বৌ নিয়ে বাড়িতে থাকতেন। গত দুই-তিন দিন আগে ছেলের বৌ তার বাবার বাড়ি যান। এই সুযোগে রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) রাতে অজ্ঞাতরা তার ঘরে ঢুকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে বাহিরে তালা ঝুলিয়ে চলে যায়।
এদিকে, সোমবার দুপুর পর্যন্ত সখিনা বেগমের সন্ধান না পেয়ে আশেপাশের লোকজনের সন্দেহ হয়। পুলিশকে খবর দিলে বাড়িতে গিয়ে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। এঘটনায় পুলিশ সাবেক স্বামী মফিজ উদ্দিন এবং প্রতিবেশী লেবু মিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে বাঁশতৈল পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে আসে। এদিকে মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে পুলিশ ফাঁড়ি হাজতে লেবু মিয়া গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে বলে পুলিশ জানায়।
লেবু মিয়ার ভাই বজলুর রশিদ বলেন, ‘আমার ভাই লেবুকে বাঁশতৈল পুলিশ ফাঁড়ি ইনচার্জ মো. সাখাওয়াত হোসেন এবং পুলিশ উপ-পরিদর্শক নেছার উদ্দিন থানায় নির্যাতন করেছে। আমার ভাইকে তারা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিয়েছে। এর বিচার চাই।’
আমার স্বামীকে বিনা অপরাধে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়। তার বিরুদ্ধে কোনও মামলা নেই। রাতে তাকে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে। আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই।
লেবু মিয়ার স্ত্রী আলিয়া বেগম বলেন, ‘আমার স্বামীকে বিনা অপরাধে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়। তার বিরুদ্ধে কোনও মামলা নেই। রাতে তাকে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে। আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই।’
তবে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে বাঁশতৈল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘ফাঁড়িতে কোনও ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। এসআই সেলিমসহ দুই জনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা মিথ্যা।’
মির্জাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ আবু সালেহ মাসুদ করিম বলেন, ‘ওই ব্যক্তি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। পরে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।’
সংবিধান, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও সংশ্লিষ্ট আইনে শাস্তির বিধান থাকলেও দেশে থেমে নেই হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু।
বাংলাদেশের সংবিধান বলছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে’ (৩১ অনুচ্ছেদ)। নবম সংসদে পাস করা ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) বিল, ২০১৩ ’-এ সরকারের হেফাজতে থাকা অবস্থায় কারও ওপর নির্যাতন চালানোকে অপরাধ বলে বর্ণনা করে এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির বিধান করা হয়েছে।
বাংলাদেশের আইন বলছে, ‘হেফাজতে মৃত্যু’ বেআইনি কাজ, অপরাধ। তারপরও এর বিচার হয় না। ২০১৩ সালের আইনে এ পর্যন্ত বিচার হয়েছে একটি।
হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনার বিচার হয় না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবার অভিযোগও করে না। পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা নেওয়ার উদাহরণ বিরল বললেও বাড়িয়ে বলা হয়। কিন্তু অভিযোগ না করেও পরিবারের যেসব অভিজ্ঞতা তা জানলেই বোঝা যায়, কেন কারও পক্ষে অভিযোগ করার সাহস দেখানো সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে হত্যাকে বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ধরনের মানসিকতাই যে সহযোগী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই কাজে পরোক্ষ ভূমিকা পালনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও যে পিছিয়ে নেই, তা এই প্রতিষ্ঠানের নির্লিপ্ততাতেই স্পষ্ট। কমিশন একবার বলেছিল যে বেছে বেছে কয়েকটা ঘটনার তদন্ত করবে, সেই কথা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কমিশনের জবাবদিহির অভাব পুলিশ এবং সরকারের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
তারা বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে পুলিশ নিজেরাই তদন্ত করে, ফল যা হওয়ার তা-ই হয়, যে পুলিশ মামলাই নিতে চায় না, তার হাতে তদন্তের ভার দিলে এর চেয়ে ভিন্ন কিছু হওয়ার কারণ নেই। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য কোনো স্বাধীন কমিশন গঠনের ইচ্ছা বা আগ্রহ যে সরকারের নেই, তা-ও সহজেই বোধগম্য।
তারা আরও বলেন, পুলিশের কর্মকর্তারা একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি করেছেন, যেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিল করে দেওয়া হয়। এই দাবি একেবারে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে এমন নয়। তদুপরি, পুলিশ বাহিনীকে যেভাবে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে, তাতে এই বাহিনীর সদস্যরা যে নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বেই ভাববেন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই; হেফাজতে মৃত্যু, বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা সেগুলো প্রতিদিন প্রমাণ করে দিচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৩৮
আপনার মতামত জানানঃ