তিতাস গ্যাস কোম্পানির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ৩৭ জন বা এর বেশি অননুমোদিত ব্যক্তি নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে কাজ করেছেন বলে তদন্ত কমিটির কাছে প্রমাণিত হয়েছে। কমিটি বলেছে, তিতাস গ্যাসের নিরাপত্তা বিভাগ যাচাই–বাছাই না করে প্যান্থার সিকিউরিটি সার্ভিসেসের দেওয়া বিল পরিশোধের জন্য নিয়োগ শাখায় পাঠিয়েছেন। দীর্ঘ সময় ধরে এ অনিয়ম চললেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
নিয়ম অনুযায়ী, তিতাসের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা কার্যালয়ে একজনকে নিরাপত্তা প্রহরী পদে চাকরি পেতে হলে জীবনবৃত্তান্ত, শিক্ষাগত যোগ্যতা, জাতীয় পরিচয়পত্র, চেয়ারম্যানের সনদ জমা দিতে হয়। নিরাপত্তা প্রহরী নেওয়ার আগে পুলিশি যাচাই (ভেরিফিকেশন) প্রতিবেদন জমা দিতে হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে যা আছে
তিতাস গ্যাস কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের মধ্যে অন্যতম নিরাপত্তা বিভাগ। কোম্পানির বিভিন্ন কার্যালয়ের কেপিআইভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নিরাপত্তায় কাজে নিয়োজিত কর্মচারীদের তদারকির দায়িত্ব নিরাপত্তা বিভাগ পরিচালনা করে। নিরাপত্তা বিভাগের নথিপত্র যাচাই করে দেখা যায়, পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে এ অনিয়ম সংঘটিত হচ্ছে। এ দীর্ঘ সময় নিরাপত্তা বিভাগের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা ‘ভুয়া’ নিরাপত্তারক্ষীদের হাজিরা প্রত্যয়ন করে নিয়োগ শাখায় পাঠিয়েছেন। কোম্পানির এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত কর্মচারীরা ঠিকভাবে কাজ করছেন কি না, তা যাচাই না করে হাজিরা শিট প্রস্তুত ও প্রত্যয়ন করা গুরুতর দায়িত্ব অবহেলার শামিল বলে কমিটি মনে করে। তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা পুরো বিষয়টি অবহেলা করেছেন বলে কমিটি মন্তব্য করেছে।
কমিটি জানিয়েছে, মেসার্স প্যান্থার সিকিউরিটি প্রতি মাসে কর্মরত জনবলের বিপরীতে যে বিল মানবসম্পদ বিভাগে দিয়েছে, তারা আসলে সেখানে কাজই করেনি। তারা চুক্তির বিভিন্ন ধারাও লঙ্ঘন করেছে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের এমন কাজ কোম্পানির নিরাপত্তার জন্য হুমকি। চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়া নিরাপত্তা প্রহরীর স্থলে অন্য নিরাপত্তাপ্রহরীকে নিয়োজিত করার বিষয়টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তা বিভাগকে জানায়নি। জালিয়াতি করায় তদন্ত কমিটি প্যান্থারকে কালোতালিকাভুক্তির সুপারিশ করেছে।
ইনস্টলেশন অব প্রি-পেইড গ্যাস মিটার ফর টিজিটিডিসিএলের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক ফয়জার রহমান বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে আমি সত্য কথা লিখেছি। নিরাপত্তার দায়িত্বে অনেক আগে কিছু লোক নেওয়া হয়েছিল। এদের জায়গায় অন্য লোকেরা এসে আগের লোকদের নামে টাকা তুলে নিয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে সত্যতা পেয়েছি। জীবনবৃত্তান্ত ছাড়া ওদের কাছে কীভাবে বিল গেল, কেউ তা তদারক করেননি। এর ফলে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। বহিরাগত লোকদের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া বিরাট অবহেলা।’
যা বলছে তিতাস
তিতাসের দুজন কর্মকর্তা বলেন, এত বড় অনিয়মের বিষয়টি নিয়ে কানাঘুষা শুরু হওয়ার পর বর্তমানে তিতাসের কোম্পানি সচিব ও তৎকালীন উপমহাব্যবস্থাপক লুৎফুল হায়দার নিজেই একটি তদন্ত কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন। ইনস্টলেশন অব প্রি-পেইড গ্যাস মিটার ফর টিজিটিডিসিএলের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক ফয়জার রহমানকে প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়। তবে কমিটিকে আর্থিক বা অসংগতির বিষয়টি বের করার বিষয়ে কার্যপরিধিতে কিছু উল্লেখ ছিল না।
ওই দুই কর্মকর্তা বলেন, এ তদন্ত প্রতিবেদন অনেক দিন ধামাচাপা দেওয়া হয়। অন্যদিকে যারা অন্য নামে নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করেছেন, তাদের কিছুদিন বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়।
আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে তিতাসে জনবল সরবরাহ করেছিল মেসার্স প্যান্থার সিকিউরিটি সার্ভিসেস। নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটিকে কালোতালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। তবে প্যান্থার সিকিউরিটি দাবি করেছে, তারা যা করেছে, তা তিতাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানিয়েই।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর, আমাকেও বিষয়টি জানানো হয়নি। জ্বালানি বিভাগকে আমি অনেকবার বলেছি নীতি মেনে পরামর্শক নিয়োগ করে নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ দেওয়ার জন্য। তারা তা করে না, কথাও শোনে না। কেন এ বিষয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি সেটা আমি জানতে চাইব, কঠিন ব্যবস্থা নেব।’
এই অনিয়মের পেছনে কারা
নিরাপত্তা প্রহরীদের হাজিরা শিটে স্বাক্ষর, প্রতিস্বাক্ষর ও প্রত্যয়ন করেছেন ১৪ জন কর্মকর্তা। তারা হলেন তিতাসের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক আবদুল হাকিম, উপমহাব্যবস্থাপক (অবসরপ্রাপ্ত) আমিরুল আসগর খান, উপমহাব্যবস্থাপক মাইন উদ্দিন, লুৎফুল হায়দার, আবুল সালেহ মাহমুদ, ব্যবস্থাপক শাহ মো. আল মাহমুদ, মিজানুর রহমান, আবদুস সালাম সরদার, ছায়েফ উদ্দীন, ব্যবস্থাপক (তৎকালীন উপব্যবস্থাপক) ফজলুল হক, উপব্যবস্থাপক মেসবাহুল আলম, সহকারী ব্যবস্থাপক শামসুল হক (অবসরপ্রাপ্ত), সহকারী ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল ও সহকারী কর্মকর্তা কারিমুল হক।
তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে নিরাপত্তা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন উপমহাব্যবস্থাপক লুৎফুল হায়দার। জনবল প্রতিস্থাপন, নিরাপত্তা প্রহরীর নামে নিয়োজিত অপর কর্মীকে বেতন-ভাতা প্রদান, নিরাপত্তা বিভাগ থেকে প্রত্যয়নের বিষয়টি যাচাই–বাছাই করার দায়িত্বও তার ছিল। জানতে চাইলে লুৎফুল হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বিভিন্ন স্থাপনা ঘুরে বিষয়টি জানতে পেরেছি। আগে জানতাম না। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান প্যান্থার যে লোক বদল করেছে, তা আমাদের বলেনি।’
তবে প্যান্থার সিকিউরিটি বলছে, তিতাসের অনুমতি ছাড়া কোনো লোককে এর নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ দেওয়া সম্ভব নয়। প্যান্থার সিকিউরিটি সার্ভিসের পরিচালক কামরুজ্জামান দুলাল বলেন, ‘তিতাসে আমরা আমাদের লোক কখনোই নিয়োগ দিতে পারি না। তিতাসের কর্মকর্তারা যাঁদের নাম দেন, আমরা তাদের তাদেরই নিয়োগ দিয়েছি। তাদের মামাতো ভাই, ফুফাতো ভাই, ইউনিয়নের তদবিরেই লোক নিয়োগ দিয়েছি। তারা আমাদের তালিকা দিয়েছিলেন, আমরা ব্যবসায়িক খাতিরে ওদের নিয়োগ দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা কাজ করতে গিয়ে তো আর যুদ্ধ করতে পারি না। আমরা যা করেছি, তাদের জানিয়েই করেছি।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১৪
আপনার মতামত জানানঃ