বাঙালি মুসলমানের অনুভূতি যে ঠিক কোন জায়গায় এটা বোঝা বড় মুশকিল। কথায় কথায় বাঙালি মুসলমানের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। আজকের বাঙালি মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতি দেখে আপনি হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবেন না, তারা অধিকাংশই একটা সময়ে ছিল হিন্দু অথবা বৌদ্ধ। তবে এটা ঐতিহাসিক সত্য। আর বাংলার মানুষের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কারণ ব্যাখ্যার জন্য চার ধরনের তত্ত্ব উপস্থাপন করা হয়েছে। এই তত্ত্বগুলো হলো মুসলমান শাসকদের ইসলাম ধর্ম প্রচারে আনুকূল্য, ব্রাহ্মণ্যবাদের উৎপীড়নের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের বিদ্রোহ, হিন্দু উৎপীড়নের ফলে উৎপীড়িত বৌদ্ধদের ইসলাম গ্রহণ এবং মুসলিম পীরদের ধর্ম প্রচার।
বহিরাগত মুসলমানরা এখানে এসে স্থায়ী হয়েছেন, আত্মীয়তা গড়েছেন এবং তাদের মাধ্যমে ইসলাম ছড়িয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু এখানে মুসলিম সমাজ তৈরি হয়েছে মূলত স্থানীয় জনগোষ্ঠীর দ্বারা। যারা আগে ছিলেন হিন্দু ও বৌদ্ধ। বিশেষত হিন্দু নিম্নবর্ণের কৃষক, কাঠুরে, জেলে ও মাঝিরা ইসলাম গ্রহণ করেন ব্যাপকভাবে। তারা ইসলামকে এখানকার প্রধান ধর্ম ও মুসলিমদের গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী করে তোলেন। তাদের পাশাপাশি উচ্চশ্রেণীর বহু হিন্দু ইসলামে দীক্ষিত হন। বাংলার মুসলিমদের মধ্যে বহিরাগত মুসলিম শতকরা ২৯.৬ ভাগ, স্থানীয় ধর্মান্তরিত মুসলিম শতকরা ৭০.৪ ভাগ। তাদের মধ্যে উচ্চশ্রেণীর হিন্দু ও বৌদ্ধ ছিলেন শতকরা ৩০ ভাগ, ৭০ ভাগ ছিলেন নিম্নবর্গের হিন্দু।
বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় ত্রয়োদশ শতকে। ইসলাম ধর্মের উদ্ভবের প্রায় ৬০০ বছর পরে বাংলায় মুসলমান রাজত্ব শুরু হয়। এই দীর্ঘ সময় ধরে ভারত মহাসাগরের বাণিজ্য মুসলমান বণিকেরা কুক্ষিগত করে রেখেছিল। কাজেই মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই এখানে মুসলমান বণিকদের আনাগোনা ছিল। এ ধরনের বাণিজ্যিক যোগাযোগ বাংলায় ইসলাম প্রসারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেনি।
তবে ত্রয়োদশ শতকে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের সঙ্গে যোগাযোগ অনেক বেড়ে যায়। তাই অনুমান করা হয় যে ত্রয়োদশ শতক থেকে শুরু করে বাংলাদেশে বড় ধরনের ধর্মান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলায় ইসলাম দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েনি। তিনটি কারণে অনুমান করা হয় যে বাংলায় ইসলাম ধর্মে দীক্ষিতকরণের প্রক্রিয়া অত্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে চলে।
তখন বাংলায় ধর্মের প্রাধান্য ছিল অনেক বেশি। হিন্দুদের জন্য ইহকালের চেয়ে পরকাল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার হিন্দুরা অতি সহজে মুসলমানদের শাসন মেনে নিয়েছে, কিন্তু ধর্মের ব্যাপারে ভারতের কোথাও হিন্দুরা আপস করতে চায়নি। এই প্রবণতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দার্শনিক উইল ডুরান্ট যথার্থই লিখেছেন, ‘হিন্দুরা একের পর এক বিদেশি সরকারকে তাদের ওপর আধিপত্য করার সুযোগ দিয়েছে, অংশত এর কারণ হচ্ছে—দেশি না বিদেশি কে তাদের শাসন বা শোষণ করছে সে ব্যাপারে তারা উদ্বিগ্ন ছিল না, তাদের কাছে রাজনীতি নয়, পরবর্তী অনন্ত জীবন ছিল তাদের আরাধ্য।’৬ এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার হিন্দুদের ভিন্ন দেশের ধর্মে দীক্ষিত হওয়া মানসিক দিক দিয়ে একটি যন্ত্রণাদায়ক সিদ্ধান্ত ছিল। কাজেই এখানে ধর্মান্তর-প্রক্রিয়া অত্যন্ত দীর্ঘ হওয়াই স্বাভাবিক।
এমনকি প্রখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা ১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দে হজরত শাহজালালের সঙ্গে দেখা করার জন্য পূর্ববঙ্গের মধ্য দিয়ে সিলেট শহরে যান। তিনি প্রত্যাবর্তনের পথে ১৫ দিন ধরে মেঘনা নদীতে ভ্রমণ করেন। মেঘনার তীরবর্তী অধিবাসীদের তিনি ‘Infidels under Muslim rule’ বা মুসলমান রাজত্বের অধীনে কাফের বলে বর্ণনা করেছেন। ইবনে বতুতার ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে এ কথা সুস্পষ্ট, পূর্ববঙ্গে চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল।
১৫১৪ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজ পরিব্রাজক বরবোসা বাংলাদেশে আসেন। তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে নিম্নরূপ বর্ণনা দিয়েছেন, ‘রাজা হচ্ছেন একজন মুসলমান। তিনি একটি বড় রাজত্বের প্রভু এবং অত্যন্ত ধনী। তিনি হিন্দুদের দ্বারা অধ্যুষিত একটি দেশ অধিকারে রেখেছেন। এখানে রাজা ও তার সহকর্মীদের কাছ থেকে সুবিধা নেওয়ার জন্য প্রতিদিন অনেক হিন্দু মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করছে।’ এসব ভ্রমণকাহিনি থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে মুসলমান শাসনের প্রথম ৩০০ বছরেও বাংলায় মুসলমান সংখ্যাধিক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
এছাড়া পশ্চিম এশিয়া থেকে যেসব ধর্মপ্রচারক ইসলাম প্রচারের জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন, তাদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে তারা ত্রয়োদশ শতক থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত বাংলাদেশে এসেছেন। বাংলাদেশে প্রখ্যাত ৫৯ জন ইসলাম প্রচারক পীর-দরবেশ সম্পর্কে একটি সমীক্ষা খানের Discovery of Bangladesh গ্রন্থে করা হয়েছে। ওই সমীক্ষা থেকে দেখা যায় যে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার আগে তিনজন পীর বাংলাদেশে এসেছিলেন। মুসলিম শাসনামলে ৫৬ জন প্রখ্যাত ইসলাম প্রচারক পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর ভারত থেকে বাংলায় আসেন। এদের ১৫ শতাংশ ত্রয়োদশ শতকে আসেন, ৩৬ শতাংশ আসেন চতুর্দশ শতাব্দীতে: ১৮ শতাংশ আসেন পঞ্চদশ শতকে, ২৩ শতাংশ আসেন ষোড়শ শতকে। মাত্র ৩ শতাংশ আসেন সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে।
এই সমীক্ষা থেকে প্রতীয়মান হয় যে বাংলায় ইসলাম প্রচার সবচেয়ে জোরেশোরে চলেছে ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী—এই ৪০০ বছর। তবে পীরেরা আসার সঙ্গে সঙ্গেই স্থানীয় হিন্দুরা মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেনি। মৃত পীরেরা জীবিত পীরদের চেয়ে কম কার্যকর নন। অনেক ক্ষেত্রে মৃত পীরদের কাছে মানত মানার সুফল পেয়েও অনেক হিন্দু মুসলমান হতে পারে। ষোড়শ শতকের তুলনায় অনেক কম পীর সপ্তদশ শতকে বাংলাদেশে আসেন। সম্ভবত ষোড়শ শতকে যে পীরেরা বাংলায় আসেন, তাদের প্রভাব সপ্তদশ শতকেও অব্যাহত ছিল। সপ্তদশ শতকের পরে বাইরে থেকে বাংলাদেশে পীরদের আগমন একেবারে কমে যায়। এতে অনুমান করা যায় যে সপ্তদশ শতকে বাংলার পূর্ব ও উত্তর অঞ্চলে মুসলমানদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে প্রায় ৫০০ বছর ধরে ধর্ম প্রচারের পর বাংলাদেশে জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৫২
আপনার মতামত জানানঃ