উপনিবেশ স্থাপনের ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে ব্রিটিশ, ডাচ এবং পর্তুগিজদের ব্যাপক সুখ্যাতি থাকলেও পিছিয়ে নেই রাশিয়া। ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা যখন উত্তর আমেরিকার পূর্ব সমুদ্র উপকূলে বসবাস শুরু করে তখন একটি ক্রমবর্ধমান বিশ্ব শক্তি উত্তর-পশ্চিম উপকূলে বসতি স্থাপনের চেষ্টা চালায়। আর ওই পক্ষটি ছিল রাশিয়া।
১৭২১ সালে গ্রেট নর্দার্ন যুদ্ধে জয়লাভের পর রাশিয়া ইউরোপের প্রভাবশালী সামরিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। তৎকালীন শাসক পিটার দ্য গ্রেট একটি পূর্ণাঙ্গ সাম্রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন যেটি কিনা বিশ্বব্যাপী পদচিহ্ন প্রসারের জন্য মুখিয়ে ছিল। সাইবেরিয়ান শীতলতা পূর্বে পৌঁছে দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করেন পিটার ও তার উত্তরসূরিরা। প্রশান্ত মহাসাগর, এখনকার অ্যালেউটিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং আলাস্কান উপকূলে পৌঁছানোর জন্য নীলনকশা আঁকে।
তবে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, রাশিয়ানরা শুধুই জমি দখল করতে চায়নি। বরঞ্চ লাভজনক পশম ব্যবসায় আধিপত্য ধরে রাখার পরিকল্পনা ছিল তাদের। পশম ব্যবসায় পিটার দ্য গ্রেট রাশিয়াকে তৎকালীন বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ অবস্থানে নিয়ে যান। রুশ সাম্রাজ্যের মোট বাৎসরিক আয়ের ১০ শতাংশই আসতো এই বাণিজ্য থেকে। চলুন জানা যাক, রাশিয়ার তৎকালীন সাম্রাজ্য প্রসার সম্পর্কে।
রাশিয়ানরা ১৬ শতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই পূর্ব দিকে থাকা সম্ভাব্য সম্পদের প্রাচুর্য সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। তবে তারা সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযান পরিচালনা করতে ১৭২৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন। ডেনিশ বংশোদ্ভূত কার্টোগ্রাফার এবং ন্যাভিগেটর ভিটাস বেরিং রাশিয়ান অভিযাত্রীদের নিয়ে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলের জমিগুলো খুঁজতে বের হন। ওই জায়গাগুলোতে শত শত বছর ধরে আদিবাসিরা বসবাস করে আসছিলেন।
বেরিং দেখেছিলেন যে, আরও পূর্ব দিকে গেলে আর্কটিক জলপথ পাড়ি দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে পৌঁছানো সম্ভব। তিনি অ্যালেউটিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং আলাস্কার উপকূলরেখার মানচিত্র তৈরি করার জন্য প্রায় এক বছর একটি অভিযান পরিচালনা করেন। আর এটিকেই রাশিয়ার উপনিবেশ স্থাপনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দেখেন পশ্চিমারা।
বেরিং ঠিকই ওই অঞ্চলটি আবিষ্কার করেছিলেন। সেখানকার আবহাওয়া ছিল বেশ ভয়ংকর ও বিপদজনক। বেরিং প্রমাণ করেছিলেন, আলাস্কা থেকে আরও দক্ষিণে পৌঁছানো সম্ভব ছিল। সেখানে বাণিজ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে বসতি স্থাপনের প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন এই বেরিং।
প্রকৃতপক্ষে একটি সংকীর্ণ চ্যানেল সাইবেরিয়ান এবং আলাস্কান ভূমিকে পৃথক করেছে। আর এই প্রণালী আবিষ্কারের কারণে তার নামানুসারে ওই প্রণালীকে বলা হয় বেরিং প্রণালী। যদিও জীবদ্দশায় তিনি এই কৃতিত্ব দেখে যেতে পারেননি। ১৭৪১ সালে স্কার্ভিতে মারা যান ন্যাভিগেটর ভিটাস বেরিং।
উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের বরফ, কুয়াশাচ্ছন্ন, ঝড়ো আবহাওয়ার কারণে ওই অঞ্চলে পশমের ব্যবসার প্রসার ঘটানো সম্ভব হয়েছিল। ১৭৪০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে ৪০ জনের বেশি পশম বণিক আলাস্কায় ঘাঁটি স্থাপনে রাশিয়ার আগ্রহকে বাড়িয়ে তোলে। সেই সাথে আঞ্চলিক দাবিগুলো টিকিয়ে রাখতে এবং পশম বাণিজ্যকে বাণিজ্যের প্রসারে নতুন নতুন উদ্যোগ নেয়।
গ্রিগরি ইভানোভিচ নামক একজন সাইবেনিয়ান বণিক আলাস্কায় পশম বাণিজ্য সম্প্রসারণে সর্বাধিক অবদান রাখেন। তার নেতৃত্বে ১৭৮৪ সালে কোডিয়াক দ্বীপের থ্রি সেন্টমার্টিন বে-তে প্রথম রুশ বসতি স্থাপন করে। এর দুইবছর পর বন্ধুকে লেখা এক চিঠিতে তিনি নতুন এলাকায় বসবাসরত আদিবাসীদের উচ্ছেদের জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন।
মূলত এই কারণেই ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত একটি অধ্যায়ে তার নামটি যুক্ত করেছে পশ্চিমারা। তার বিরুদ্ধে শতাধিক কোডিয়াকের আলুটিক আদিবাসীকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। তবে এই কথা স্পষ্ট যে, রাশিয়ান বসতি স্থাপনকারী এবং স্থানীয় আদিবাসীদের মধ্যে সম্পর্ক সবসময় অস্থিতিশীল ছিল। স্থানীয় সম্প্রদায়গুলো রাশিয়ান বণিকদের সাথে ব্যবসা করার সময় তাদের জমি দখল এবং ধর্মান্তরকরণের তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ১৮০২ সালে স্থানীয় লিংগিট যোদ্ধারা বেশ কয়েকটি রাশিয়ান ফাঁড়ি ধ্বংস করে। তবে পরের ২ বছর চলা রক্তক্ষয়ী লিংগটি যুদ্ধের মধ্যদিয়ে ফের নিয়ন্ত্রণ হারায় আদিবাসীরা।
শেলিখভ আলাস্কায় তার কাজের জন্য ক্যাথরিন দ্য গ্রেটের কাছ থেকে প্রশংসা এবং সম্মান পেয়েছেন। তিনি সম্রাজ্ঞীর নির্দেশে সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে আসেন। তার পরিবর্তে আলেকজাস্ডার বারানভকে সেখানে নিযুক্ত করা হয়। পরে তিনি রাশিয়ান-আমেরিকান কোম্পানি আরএসি-এর প্রথম পরিচালক হিসেবে আলাস্কান ঘাঁটি পাভলস্কায় স্থানান্তরিত করেন। সেখানেই শুরু হয় নতুন বসতি স্থাপন। তিনি আরও বড় লক্ষ্য স্থির করেছিলেন ওই অঞ্চলে। শুধু পশম ব্যবসা বজায় রাখার জন্যেই নয়, সেখানে রাশিয়ান রাজনীতি এবং ধর্মীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন বারানভ।
তিনি ইয়াকুটাতে খামার প্রতিষ্ঠার জন্য রাশিয়ান মূল ভূখণ্ড থেকে সারফ আমদানি করেছিলেন। তিনি দুর্গ গড়েন সেখানে। এছাড়াও করাতকল এবং ট্যানারি খুলেছিলেন নতুন ওই অঞ্চলে। ধীরে ধীরে কয়লা, লৌহার মতো আকরিক মজুদ করা হয় সেখানে। তবুও আলাস্কায় রাশিয়ানরা বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করেছিল।
রাশিয়ান অভিযাত্রী নিকোলাই রেজানভ, নভো-আনখানগেলস্ক পরিদর্শন করার সময় বর্ণনা করেছিলেন সেখানকার ভয়াবহতা সম্পর্কে। সেখানে খুবই স্যাঁতসেঁতে ছিল জনজীবন। এছাড়াও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা একটি বড় সমস্যা ছিল। স্থানীয়দের গণহত্যার পরে খাদ্য ও রসদের জোগান পেতে সাইবেরিয়ার উপর ফের নির্ভরশীল হয়ে পড়ে রাশিয়ান উপনিবেশিকরা।
রেজানভ সেখানে গিয়ে মার্কিন বণিকদের কাছ থেকে একটি জাহাজ ক্রয় করেন। পরে তিনি নতুন জমি অনুসন্ধানে সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার স্প্যানিশ বস্তিগুলোর দিকে অগ্রসর হন। মূলত তিনি সেখানে নিজের জন্যেও একটি বড় সুযোগের আশায় ছিলেন। তিনি স্প্যানিশদের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করে ফেরেন। রাশিয়ান সরঞ্জাম এবং অস্ত্রের বিনিময়ে সেখান থেকে খাদ্যসামগ্রী ক্রয় করেন রেজানভ। পরে তিনি স্থানীয় স্প্যানিশ গভর্নরের কিশোরী কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। এতে করে সান ফ্রান্সিসকোসহ অন্যান্য স্প্যানিশ বস্তির সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের অনুমোদন পান।
রেজানভ আরএসিকে আনও বিস্তৃত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। যাইহোক, সেন্ট পিটার্সবার্গে ফেরার পথে রেজানভ মারা গেলেও বারানভ তার সকল পরামর্শ মেনে কাজ পরিচালনা করেছিলেন। ১৮১২ সালে তিনি এফোর্ট রস প্রতিষ্ঠা করেন যা সোনোমা কাউন্টি হিসেবে পরিচিত।
শেষপর্যন্ত অবশ্য রাশিয়ার ভৌগোলিক সম্প্রসারণ আলাস্কায় উপনিবেশকে বাঁচাতে পারেনি। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ওই অঞ্চলের বস্তিগুলো ধ্বংস করে দিয়েছিল। রাশিয়ার উপনিবেশ স্থাপনের লাগাম টানতে তাদের পশমের ব্যবসা হ্রাস করতে থাকে অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ। এক পর্যায়ে রাশিয়ান নেতারা আলাস্কায় উপনিবেশ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে শুরু করে। পরে রাশিয়ার কাছ থেকে ৭.২ মিলিয়ন ডলার মূল্যে আলাস্কা কিনে নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেকালে রাশিয়ার দুর্বল কূটনীতি আলাস্কার গুরুত্ব না বুঝলেও আজকে ঠিকই আপসোস করছে তারা।
এসডব্লিউ/এসএস/২০৪৫
আপনার মতামত জানানঃ