কক্সবাজারের টেকনাফে ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে ১৭ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের দায়ে কক্সবাজারের গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন কর্মরত বহিষ্কৃত সাত সদস্যকে সাত বছর ও পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়া দুই ধারায় এক লাখ ও দুই লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড অনাদায়ে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২টার দিকে কক্সবাজার জেলা দায়রা ও জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল এ রায় ঘোষণা করেন।
বাদীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর জানান, অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় বিচারক এই রায় ঘোষণা করেছেন। বিচারক ৩৬৫ ধারায় পাঁচ বছর এবং ৩৮৬ ধারায় সাত বছর কারাদণ্ড দেন। উভয় সাজা তাদের একসঙ্গে ভোগ করতে হবে। ফলে সাজা সাত বছর বলে গণ্য হবে। রায় ঘোষণাকালে সাত আসামিই এজলাসে উপস্থিত ছিলেন।
মামলার বিবরণে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর কক্সবাজার শহরের থানার পেছনের রোড থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিরা টেকনাফের ব্যবসায়ী আবদুল গফুরকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যান। এরপর ‘ক্রসফায়ারে’ মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে তার স্বজনদের কাছে এক কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। দেনদরবারের পর ১৭ লাখ টাকা দিতে রাজি হয় পরিবার। টাকা পৌঁছে দেওয়া হলে পরের দিন ভোররাতে আবদুল গফুরকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুরে ছেড়ে দেওয়া হয়।
বিষয়টি গফুরের স্বজনরা সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা চৌকির কর্মকর্তাকে জানান। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য সেনাবাহিনীর এই নিরাপত্তা চৌকি স্থাপন করা হয়েছিল। মুক্তিপণ আদায়কারী ডিবি পুলিশের সদস্যরা মাইক্রোবাসে মেরিন ড্রাইভ সড়কে পৌঁছালে চৌকির সেনাসদস্যরা মাইক্রোবাস তল্লাশি করে ১৭ লাখ টাকা পান। এ সময় ডিবির উপপরিদর্শক (এসআই) মনিরুজ্জামান দৌড়ে পালিয়ে গেলেও বাকি ছয়জনকে ঘটনাস্থল থেকে আটক করেন সেনাসদস্যরা।
এ ঘটনায় ব্যবসায়ী আবদুল গফুর বাদী হয়ে ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মনিরুজ্জামান ও আবুল কালাম আজাদ, এএসআই ফিরোজ, গোলাম মোস্তফা ও আলাউদ্দিন এবং দুই কনস্টেবল আল আমিন ও মোস্তফা আজমকে আসামি করে মামলা করেন। ঘটনার প্রায় ১০ মাস পর ২০১৮ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে ডিবির সাতজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
পিপি ফরিদুল আলম বলেন, মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আজ রায় হলো। রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।
ব্যবসায়ী আবদুল গফুরের ভাই টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান বলেন, এই ঘটনায় মামলা দায়ের করায় আমাদের পরিবারকে ব্যাপকভাবে হয়রানি করা হয়েছে। আসামিরা তৎকালীন টেকনাফ থানার ওসি সিনহা হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি প্রদীপ কুমার দাশের সঙ্গে যোগসাজস করে বিভিন্ন মিথ্যা মামলাসহ নানাভাবে হয়রানি করেছে। এসব নির্যাতনে আমার ভাই গফুর মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেছে।
প্রসঙ্গত, অপহরণের ঘটনায় গ্রেপ্তারের পর ডিবির সাত সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পুলিশের গঠিত তদন্ত কমিটি ডিবির সাত পুলিশের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার সুপারিশও করে। বিভাগীয় মামলার কার্যক্রমটি এখনো চলমান রয়েছে।
বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, জনগণের জানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান, অপরাধ প্রতিরোধ ও দমনে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। শুধু আইন পরিপালন নিশ্চিত করা আর অপরাধ প্রতিরোধ বা দমনই নয়, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বলা হয়। এই বিভাগ যেকোনো দেশ ও জাতির একটি স্থায়ী সম্পদ। তারা আইন ও নীতি-নৈতিকতার ব্যাপারে উচ্চতর স্থানে থাকার কথা। অথচ সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে পুলিশের কিছু সদস্য বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ প্রবণতা এতই বাড়ছে যে, সহকর্মীরাও যৌন হয়রানি, ধর্ষণ থেকে ছাড় পাচ্ছে না। কেউ কেউ হত্যা, ধর্ষণ ও ডাকাতির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। বিশেষ করে চাঁদাবাজি ও মাদকের সাথে সম্পৃক্ত থাকা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধী যেই হোক, অপতৎপরতা-অনৈতিক থেকে পুলিশ বিভাগকে মুক্ত করার জন্য শক্তিশালী জবাবদিহির ব্যবস্থা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়াও যুগোপযোগী আইনেরও প্রয়োজন। প্রয়োজন আইনের সংস্কার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা যদি অনৈতিক কাজ করে আর শাস্তি যদি ১০০ টাকা হয় অপরাধ দমন তো হবেই না, বরং উৎসাহিত হবে। আর অপরাধ দমনের দায়িত্বে নিয়োজিতদের মধ্যে যারা নিজেরাই অপরাধে লিপ্ত হয়, তাদের শাস্তি অধিকতর কঠোর হওয়া দরকার।
তারা বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে আসছে দীর্ঘ দিন থেকে। অথচ ঘুষ, অনৈতিক, দুর্নীতির কারণে অভিযুক্ত এই বাহিনী তার পেশাদারিত্ব হারাচ্ছে। জনগণের প্রতি তার দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়ে জনগণের গর্বের বাহিনীতে পরিণত করতে হবে ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৬
আপনার মতামত জানানঃ