এ বিশ্বে ক্ষমতাধর যারা, তারাই জলবায়ুকে ধ্বংস করছে। গ্লোবাল নর্থের দেশগুলো ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু নিরপেক্ষ হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন সীমিত।
গত শনিবার ও রোববার (১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর) দুই দিনের ‘বাংলাদেশ ইয়ুথকপ-২০২২’ শীর্ষক ভার্চুয়াল প্রি-কপ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক শিশুশান্তি পুরস্কার বিজয়ী ও যুব আইকন গ্রেটাথুনবার্গ এ কথা বলেন।
বিশেষ অতিথি হিসাবে তিনি আরও বলেন, ‘তারা উদ্যোগী হলে কোটি কোটি মানুষের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অবিলম্বে তাদের কার্বন নির্গমন কমিয়ে দিত। কিন্তু তারা উদ্যোগী নন, বরং তারা ইচ্ছা করে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলো ধীর গতিতে বাস্তবায়ন করছে। শুধুমাত্র নিজদের সুবিধা, ব্যবসা ও অতিরিক্ত মুনাফার জন্য তারা এমনটি করছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা যদি আজকের মতো চলতে থাকি, তাহলে কপ-২৭ সম্মেলন তাদের জন্য বিশ্বকে দূষিত করার আরেকটি সুযোগ হবে। আমরা এর পুনরাবৃত্তি ঘটতে দিতে পারি না।
বৈশ্বিক স্তরে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনাসহ এ বিষয়ে তরুণদের উৎসাহিত করতে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ ও ব্রাইটার্স সোসাইটি অব বাংলাদেশ যৌথভাবে এ সম্মেলনের আয়োজন করে।
তরুণ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি জান্নাতুল মাওয়া বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও বিশুদ্ধ পানির সংকট বেড়েছে। আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন আমাদের দেশের নারীরা।’
মাওয়া বলেন, নারীর জলবায়ু ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হলে নারীদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এ দুটি বিষয় পারষ্পারিক সম্পর্কযুক্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ থাকা উচিত।
বিশেষ অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে জাতিসংঘের নতুন আবাসিক সমন্বয়কারী জিন লুইস বলেন, আমরা যখন কথা বলছি, তখনও জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। প্রশমন ও খাপ খাওয়ানোর জন্য অনেক অনেক পরিকল্পনা ও জায়গা রয়েছে। তবে এখন আলোচনার চেয়ে পদক্ষেপ জরুরি। এ ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে হবে।
‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও বিশুদ্ধ পানির সংকট বেড়েছে। আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন আমাদের দেশের নারীরা।’
আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তন ও উন্নয়ন কেন্দ্রের পরিচালক প্রফেসর সালিমুল হক বলেন, কপ-২৭ সম্মেলন থেকে বেশি আশা করা ঠিক হবে না। বিশ্বের নেতারা সম্মেলনে একত্রিত হন, কিছু বিষয়ে আলোচনা হয় কিন্তু কিছু ছোট উদ্যোগ ছাড়া বড় কোনো পদক্ষেপ নেন না। সুতরাং, শুধুমাত্র কপে অংশগ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গতকালের জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা আজকের বা আগামীকালের জন্য একরকম নয়। আমরা ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত লস অ্যান্ড ড্যামেজ যুগে প্রবেশ করেছি।
আমাদের কপে এ বিষয়গুলি তুলে ধরতে হবে। বিশ্বের দূষণকারী দেশগুলোকে অবশ্যই সম্মত হতে হবে এবং দূষণের ভুক্তভোগীদের অর্থ দিতে হবে। অন্যদের সমর্থন ও সম্পৃক্ত করার জন্য তরুণদের নেতা ও কর্মী হিসেবে কাজ করতে হবে।
সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশেরশ এর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোয়ালিটি প্রোগ্রাম পরিচালক রিফাত বিন সাত্তার বলেন, আমরা একটি বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থায় বাস করছি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমাজে বৈষম্যও বাড়ছে। সঠিক তথ্য ও বিশ্লেষণের অভাব আমাদের জলবায়ু নীতিতে বিরুপ প্রভাব ফেলে। আমাদের এই শূন্যতা পূরণ করতে হবে। পুরো বাজেট প্রক্রিয়ায় স্থানীয় প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে হবে। আমরা ইতোমধ্যে ব্যর্থ। তাই নেতৃত্বের প্রশ্নে তরুণদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে।
উদ্বোধনী অধিবেশনে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব জিয়াউল হাসান এনডিসি বলেন, যদিও আমরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছি, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের স্বার্থ অভিন্ন। যুবসমাজকে এই প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত করতে হবে। যাতে তারা তৃণমূল স্তরের জনগণ এবং নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করতে পারে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ এর ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন আজকের সমস্যা নয়; আগামীকালের সমস্যা নয়; পরশুর নয়। ৩০ বছর পরে হয়তো আমরা এখানে থাকব না, তাই এটি আপনারই সমস্যা। সঠিক দিক ও পরিধিতে কাজ করার জন্য তরুণদের সমস্যাটি বুঝতে হবে। বহুব্যবহার, ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্ব্যবহার এই তিন বিষয় নজের নিয়ে বাংলাদেশে নিঃসরণ হ্রাস এবং প্রশমনে উপকৃত হতে পারে। তরুণরা টেকসই উন্নয়ন এবং জলবায়ু ন্যায়বিচারের মধ্যে যোগসূত্র বোঝে। তারা টেকসই সমাধানের জন্য উদ্ভাবক হিসাবে অগ্রগণ্য হয়ে উঠেছে।
একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, বৈরী আবহাওয়া এবং আকস্মিক জলবায়ু পরিবর্তন তরুণদের ঝুঁকিতে ফেলেছে; তাই, তরুণরা বুঝতে চায় কী ঘটছে, কীভাবে তারা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে পারে এবং কীভাবে তাদের কণ্ঠস্বর, তাদের উদ্বেগগুলি কপ-২৭ সম্মেলনে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশে ইয়ুথ কপ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং জাতীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। সম্মেলনের মাধ্যমে এবং নীতিনির্ধারক এবং যুব নেতৃত্বের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন স্থাপন হবে যেখানে একটি সমস্যা উপেক্ষা করা না হয়।
সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢাকা-৯ আসনের সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন হলো তরুণদের একটি এজেন্ডা, যার সমাধান তরুণদের দ্বারা ও তরুণদের জন্যই হবে।
‘তরুণদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার উপযুক্ত সময় এসেছে। জলবায়ু সমস্যা সমাধানের ফ্রন্টলাইনার তরুণরা হলেও, প্রায়ই নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে তাদের উদ্বেগ প্রতিফলিত হয় না।’
তিনি আরও বলেন, আমরা তরুণদের কণ্ঠস্বর ও তাদের সুপারিশগুলোকপ সম্মেলনে তুলে ধরার চেষ্টা করি। আমরা তরুণদের সঙ্গে ক্রমান্বয়ে সম্পৃক্ত হচ্ছি।
এ সম্মেলনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তরুণ প্রতিনিধিরা ছয়দফা দাবি তুলে ধরেন।
দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখা, জীবাশ্ম জ্বালানি না পুড়িয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করা, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া।
দাবিগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে- উন্নত দেশগুলোর বাসিন্দাদের জলবায়ু রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রভাবিত নারী-শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত করাসহ অভিযোজনের জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৫
আপনার মতামত জানানঃ