হারেম শব্দটি শুনলেই প্রথমে চোখে ভেসে উঠে শত শত সুন্দরী রমণী আর তার মাঝে কোনো রাজা/সম্রাট নিজের অবৈধ প্রণয় লীলা চালাচ্ছেন। হারেমের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় তুর্কি সাম্রাজ্যে। মোঘল সম্রাজ্যের হারেমও ছিল অতি বিখ্যাত। তবে অন্য সাম্রাজ্যেও হারেম ছিল। ইউরোপ কিংবা চীন সাম্রাজ্যেও হারেমের উল্লেখ পাওয়া যায়। আসলে হারেম প্রায় সব রাজাদেরই ছিল। তবে তুর্কী ও মোঘলদের হারেম ছিল অন্যদের চেয়ে বহুগুণে প্রসিদ্ধ।
হারেমে যে কেবল সম্রাটের ভোগপণ্য সুন্দরী রমণী ও রাণীরাই থাকতো এমন ধারণা একেবারেই ভুল। হারেমে সুন্দরী রমণী নারীরা ছাড়াও সম্রাটের স্ত্রী, মা, নারী আত্মীয়, সাদা কালো খোজা যারা ছিল হারেমের পাহারাদার, সম্রাটের অবিবাহিত কণ্যারা, এছাড়াও সম্রাটের যুবরাজরাও এই হারেমেই বেড়ে উঠতেন।
সম্রাটেরা প্রতিদিন তাদের হারেম থেকে এক বা একাধিক সুন্দরী রমণী পছন্দ করে নিজের শয্যাসঙ্গী করতেন। এই রমণীরা ছিলো দেশ ও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগমন করা সুন্দরী রূপসী। সম্রাটের শয্যাসঙ্গী হিসেবে হারেম থেকে অগ্রাধিকার পেতেন হারেমে থাকা কুমারী রূপসীরা। সম্রাটের শয্যায় পাঠানোর আগে সেই রমনীকে অন্য দাসী ও নারীরা তাকে দুধ ও গোলাপে গোসল করিয়ে বিভিন্ন অলংকার ও প্রসাধনী ব্যবহার করে এবং দামী বস্ত্র পরিধান করিয়ে তাকে সুসজ্জিত করা হতো। সম্রাটের কাছে কেউ একবার ব্যবহার হয়ে যাওয়া বস্ত্ দ্বিতীয়বার পরিধান করে যেত না। প্রতিবার নতুন বস্ত্র পরিধান করে যেতে হতো।
যে সম্রাট বা রাজা বা সুলতান যতো বেশি অভিজাত, ক্ষমতাশালী ও অর্থবিত্তের অধিকারী তার হারেমে নারীর সংখ্যাও ততো বেশি থাকত। তখনকার রাজা বাদশাহদের আমলে যুদ্ধবিগ্রহ কম-বেশি লেগেই থাকত। আর যুদ্ধে পরাজিতদের স্ত্রী কন্যাকে দাস-দাসী হিসেবে হারেমে নিয়ে আসা হতো। কখনো বিয়ে কিংবা উপঢৌকন হিসেবে কাউকে আনা হতো। কাউকে দাসীরূপে ক্রয় করে আনা হতো। সেই দাসী কাল ক্রমে জায়গা পেত সম্রাটের হারেমে।
এছাড়া সম্রাটের কোনো অনুচর তাকে জানাল যে, অমুক জায়গায় অমুকের একটা সুন্দর মেয়ে আছে। সম্রাট বলে দিতেন ঠিক আছে তাকে হারেমে নিয়ে আসো। অনুচরেরা তাকে হারেমে নিয়ে আসত। কিংবা কোনো কৃষক খাজনা দিতে ব্যর্থ হলে খাজনাস্বরূপ তার পুত্র-কন্যাকে তুলে নেয়া হতো। পুত্রকে দাস হিসেবে রাজার কাজে লাগানো হতো এবং কন্যাকে দাসী হিসেবে হারেমে প্রেরণ করা হতো। এভাবে নানা উপায়ে হারেমে নারী সংগ্রহ করা হতো।
সারাদেশে দূর্ভিক্ষ লেগে থাকলেও হারেমে উচ্চাবিলাসী খাবারের অভাব ঘটতো না কখনো। তুর্কী হারেমে নাকি রসুইঘরই থাকতো ১০ টার অধিক। আর সুঅভিজ্ঞ পাচক থাকতো ১৫০ এর অধিক। এছাড়া জ্বাল, মশলা, জিনিসপত্র এগিয়ে কাটাকুটির জন্য থাকতো আরো অনেক ভৃত্য। প্রতিদিন নাকি ২০০ গাড়ি জ্বালানিই লাগতো হারেমের উনুন জ্বালানোর জন্য! সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকা হতো সুলতানের খাদ্য সম্পর্কে।
সুলতানের রসুইঘর ছিল হারেমের অন্য রসুইঘর থেকে একদম আলাদা। রান্নার অর্ধেক শেষ হলে তা প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হতো, কারন বাকি কাজ সেখানেই হতো। সবশেষে সুলতান খাবার টেবিলে বসার আগে খাবারে মেশানো হতো বিশেষ মশলা। এরপর সুলতান খেতে বসতেন একা, এরপর খেতো রানি দাসী বাদী ও হারেমের রূপসীরা। তারা যা খুশি খেতেন। দেশে লাখ লাখ প্রজা হয়তো অনাহারে দিন কাটাচ্ছে কিন্তু হারেমে অঢেল খাদ্য।
হারেমের একমাত্র প্রধান আকর্ষণ ছিলেন সম্রাট বা সুলতান। সুলতান একমাত্র পুরুষ যিনি হারেমে প্রবেশ করতে পারতেন। সুলতান ছাড়া অন্য কেউ হারেমে প্রবেশ করলে তার জন্য মৃত্যুদণ্ড ছিল অনিবার্য। সুলতান তার হারমের সুরক্ষিত করতে নিয়োগ করতেন খোজাদেরকে। খোজা মূলত পুরুষ কিন্তু তাদের পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা হতো। পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলার কারন হচ্ছে যাতে তারা হারেমের সুন্দরীদের ভোগ করতে না পারে।
খোঁজা তৈরি করার জন্য সে সময় ক্রীতদাস ব্যবসায়ীরা ছোট ছেলেদের যৌনাঙ্গ কেটে ফেলত। দেখা যেত একজন খোজা বানাতে গিয়ে ৩০ জনের মৃত্যু হচ্ছে। যেই একজন বেঁচে যেতো সেই একজনকে তারা সুলতানের কাছে চড়া দামে বিক্রি করত। এই খোজারা হতেন অনেকটা মেয়েলি স্বভাবের তারা গান, নৃত্য, কবিতা ভালোবাসতেন যেমনটা নারীরা ভালোবাসতেন। নারীদের প্রায় সব স্বভাবই তাদের মধ্যে থাকতো।
একটি হারেমে খোজা থাকতো ১০০ থেকে ১৫০ এর অধিক। খোজাদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ দুই রকমের খোজা ছিল। শোনা যায় সুলতানরা নাকি এই শ্বেতাঙ্গ খোজাদের সঙ্গে নিজের বিকৃত যৌনাচার ও চালাতেন। মাঝেমধ্যে এই খোজাদের মধ্যে নতুন করে পরুষত্ব জেগে উঠতো। তারা লুকিয়ে লুকিয়ে হারেমের রূপসীদের ভোগ করতো। হারেমের রূপসীরাও তা গোপন রাখতো। হারেমের কোনো খোজার নতুন করে পুরুষত্ব জেগে উঠেছে এমন খবর সুলতানের কাছে গেলে সুলতান তা হেকিমকে দিয়ে পরীক্ষা করতেন এবং আবার তার অস্ত্রপ্রাচার করতেন। ফলে দেখা যেত বেশিরভাগ খোজারই মৃত্যু হতো।
হারেমের সবচেয়ে অভিনব আয়োজন গুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে হামাম। হামাম অর্থ স্নানাগার। এই হামামের ক্ষেত্রে মুঘল কিংবা অন্য সাম্রাজ্যের হামাম থেকে তুর্কি হামামের জৌলুশ ছিল অন্য মাত্রার। একবার এক প্রত্যক্ষদর্শী তুর্কী হামামের বর্ণনা দিয়েছিলেন, পৃথিবীতে এমন সুন্দর বাথরুম দ্বিতীয়টি নেই। বাথরুমের চারদিকে থাকতো পানির ফোয়ারা। পানির নলগুলো থাকতো সোনা ও রূপোয় মোড়ানো। পাত্রগুলো থাকতো থাকতো হীরা ও রৌপ্যমন্ডিত। সোনা ও রূপার সেই পাত্রে গরম ও ঠাণ্ডা উভয় পানি থাকতো। মেঝে থাকতো দামী পাথরে মোড়ানো। দেয়ালে থাকতো গোপাল ও রমমারী সুগন্ধির উৎস। একবার চোখে দেখলে তার থেকে চোখ ফেরানো ছিল কষ্টকর।
একটি হারেমে হামাম ছিল অনেকগুলো। হারেমের রূপসীরা সেখানে প্রায় সবাই একসঙ্গে গোসল করতেন। তাদের বেশিরভাগই তখন থাকতেন অর্ধনগ্ন কিংবা পুরোপুরি নগ্ন। সম্রাট / সুলতানরা কখনো কখনো লুকিয়ে লুকিয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করতেন।
হারেমের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯ শতকের শুরু দিকে। হারেমে যে সব নারী একবার প্রবেশ করতো তাদের বের হবার খুব একটা সুযোগ ছিল না। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের শেষে সমাপ্তি ঘটেছিল মুঘল হারেমের। তার আরো অনেক পরে সমাপ্তি ঘটেছিল তুর্কি হারেমের কামাল পাশার মাধ্যমে। সেসময় নাকি নানা বয়সী প্রায় ৩৭০ জন নারী তুর্কী হারেমে ছিল।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯১০
আপনার মতামত জানানঃ