রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে গমের দাম কমে যাওয়ার পর এখন ধারাবাহিকভাবেই কমছে। যুদ্ধ শুরুর পর গত মে মাসে যেখানে প্রতি টন গম ৫০০ ডলারের বেশি দামে বিক্রি হয়েছিল। আড়াই মাসের ব্যবধানে এখন প্রতি টন গম বিক্রি হচ্ছে ৩১০ থেকে ৩২৫ ডলারে।
তবে দুই মাস ধরে বিশ্ববাজারে গমের দাম কমলেও এর প্রভাব নেই ভোগ্যপণ্যের অন্যতম বাজার খাতুনগঞ্জে। দাম কমার বিপরীতে উল্টো এখন খাতুনগঞ্জে গমের দাম বাড়ছে। গত মাসের তুলনায় প্রতি মণে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
জুনে যেখানে প্রতি মণ ভারতীয় গম বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার ৩৫০ থেকে ১ হাজার ৪৫০ টাকায়। এখন ওই গম প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকায়।
কেন কমছে না দাম
এ সর্ম্পকে খাতুনগঞ্জের এফএম ট্রেডার্সের মালিক মো. মহিউদ্দিন বলেন, বিশ্ববাজারে দাম কমলেও খাতুনগঞ্জে এর কোনো প্রভাব নেই। উল্টো এখন বাজারে গমের দাম বাড়ছে। গত বুধবার প্রতি মণ ভারতীয় গম বিক্রি হয় ১ হাজার ৫৩০ টাকায়। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ান গম প্রতি মণ বিক্রি হয় ১ হাজার ৮৭০ টাকায়।
অথচ গত মাসে বাজারে ভারতীয় গম বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৩৫০ টাকায়। তিনি আরও বলেন, এখানে যারা (আমদানিকারকেরা) গম সরবরাহ করেন, তারা যদি না কমান, তাহলে দাম কমার সুযোগ নেই।
অন্যদিকে আমদানিকারকেরা বলছেন, ডলারের দামের ঊর্ধ্বগতি ও আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার সময় বাড়িয়ে দেওয়ায় তাঁরা বিশ্ববাজারের সঙ্গে দেশীয় বাজারের দাম সমন্বয় করত পারছেন না।
তারা বলছেন, বিশ্ববাজারে ৩০ শতাংশ দাম কমেছে; তবে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় সেটি সমন্বয় করতে পারছেন না। কারণ, গমের দাম কমলেও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজারে দাম কমে যাওয়ার কোনো প্রভাব পড়ছে না।
ইনডেক্সমুন্ডির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিশ্ববাজারে প্রতি টন গমের দাম ছিল ৩৭৪ ডলার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ঘোষণার পরপর ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে দাম বাড়তে থাকে। মে মাসে দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৫২২ ডলারে।
এরপর বিশ্ববাজারে গমের দাম কমতে থাকে। জুনে প্রতি টন গম বিক্রি হয় ৪৬৫ ডলারে। এরপর আগস্টে দাম আরও কমে এখন প্রতি টন গম বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩১০ ডলারে। এই হিসাবে বিশ্ববাজারে গত দুই মাসে গমের দাম কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ।
অন্যদিকে বিজনেস ইনসাইডার ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, জুনের শেষে বিশ্ববাজারে কমতে শুরু করে গমের দাম। জুলাই মাসে দাম কমে প্রতি টন গম বিক্রি হয় ৩২৫ থেকে ৩৫৭ ডলারে। চলতি আগস্টে দাম আরও কমতে থাকে। ৪ আগস্ট প্রতি টন গম বিক্রি হয় ৩৪২ ডলারে। গত ১৯ আগস্ট বিক্রি হয় ৩১৩ ডলারে।
যদিও গমের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার সুযোগ নেই বলে জানান চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, রাশিয়া থেকে গম আমদানি না হলেও বাজারে গমের সংকট হবে না। কারণ, কানাডাতে প্রচুর পরিমাণে গম উৎপাদন হয়েছে। ওই দেশ থেকে গম আসছে, ফ্রান্স থেকে আসছে, আর্জেন্টিনা থেকেও গম আসছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত এপ্রিল থেকে বিশ্বে গমের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়। বাংলাদেশে হু হু করে দাম বাড়তে থাকে গমের। ফলে আটা-ময়দা থেকে শুরু করে গমজাত খাদ্যপণ্যের দামও বাড়তে থাকে। কানাডা বাদে বাংলাদেশের গমের অন্যতম উৎস রাশিয়া, ইউক্রেন ও ভারত। যুদ্ধের কারণে রাশিয়া-ইউক্রেন ও সবশেষ ভারত থেকে গম আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। চাহিদা বেশি থাকলেও ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪০ লাখ ১২ হাজার টন গম আমদানি করতে পেরেছিল।
কী পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার
সূত্র মতে, রাশিয়া থেকে পাঁচ লাখ টন গম আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। জিটুজি ভিত্তিতে এসব গম আমদানি করা হবে। প্রতি কেজি গমের দাম পড়বে ৪০ টাকা ৮৫ পয়সা। মোট খরচ হবে ২ হাজার ৪২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। রাশিয়াকে সরকার এই গমের মূল্য ডলারে পরিশোধ করবে।
অতিরিক্ত সচিব বলেন, টেবিলে উত্থাপিত প্রস্তাবের মধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় রাশিয়া থেকে জিটুজি পর্যায়ে পাঁচ লাখ টন গম আমদানির প্রস্তাব। প্রতিকেজি গমের মূল্য ধরা হয়েছে ৪০.৮৫ টাকা। রাশিয়ার একটি কোম্পানিকে সুপারিশ করা হয়েছে। এতে মোট ব্যয় হবে দুই হাজার ৪২ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
কোন কারেন্সিতে কেনা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের প্রস্তাবে টাকার অঙ্ক দেওয়া হয়েছে। মিটিংয়ে কোন কারেন্সিতে কেনা হবে বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে ডলারে কেনা হবে। সে হিসাবে ২১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। প্রতি ডলার ৯৫ টাকা ধরে করা হয়েছে। প্রতি টন ৪৩০ মার্কিন ডলার।
পাশাপাশি সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, চাল ও গমের দাম নির্ধারণ করে দেবে সরকার।
তিনি বলেন, তেলের মতো সরকার চাল ও গমসহ নয়টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেবে। ট্রারিফ কমিশন আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এসব পণ্যের যৌক্তিক মূল্য বের করবে। কেউ নির্ধারিত মূল্যের বেশি নিলে তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে।
গত মঙ্গলবার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মন্ত্রী এসব কথা জানান।
নয়টি পণ্যের মধ্যে রয়েছে চাল, গম (আটা ও ময়দা), চিনি, ভোজ্যতেল, মশুর ডাল, পেঁয়াজ, এম এস পণ্য এবং সিমেন্ট।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১৪
আপনার মতামত জানানঃ