দাসপ্রথা! মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন বিনিময় ব্যবস্থার একটি হলো এই দাসপ্রথা। খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রাচীন ব্যাবিলনে দাসপ্রথার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। তারও আগে প্রাচীন মিশরে আজ থেকে সাড়ে তিন কিংবা চার হাজার বছর আগে দাসপ্রথার প্রচলন ছিল বলে গুঞ্জন শোনা যায়, তবে সেই গুঞ্জন নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক।
দাসপ্রথার কথা মাথায় আসলেই প্রথমেই চোখে ভাসে একদল কৃষ্ণাঙ্গের মুখ, যাদেরকে আটলান্টিক পাড়ি দিতে হয়েছিল সাদা চামড়ার লোকদের অধীনে খাটাবার জন্য? তবে ইতিহাসের পাতায় যে শুধু কৃষ্ণাঙ্গরাই দাসত্বের শিকার হয়েছিলেন তা কিন্তু নয়। সপ্তদশ শতকে বিশ্বে কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের চেয়ে শেতাঙ্গ দাস বেশি বিক্রি হয়েছে এবং তাদের মৃত্যুর হারও ছিল শতকরা ৩৭ থেকে ৫০ ভাগ।
শেতাঙ্গ দাস ইতিহাসের এমন এক অধ্যায় যা নিয়ে ইতিহাসের কোনো বইতে লেখা হয়নি। তবে কেন এই শ্বেতাঙ্গ দাস ব্যবস্থার দিকে ইতিহাসবিদরা তেমন একটা দৃষ্টিপাত করেননি? কারণ হিসেবে ইতিহাসবিদ রবার্ট ডেভিস তার বইয়ে ব্যাখ্যা করেছেন, “ইতিহাস শ্বেতাঙ্গদেরকে শোষণকারী ঔপনিবেশিক হিসেবেই তুলে ধরতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছে, যতটা না করেছে দাসব্যবস্থার শিকার হিসেবে।”
আমেরিকায় শেতাঙ্গদের দিয়ে সূচনা হয়েছিল দাসপ্রথার। ১৬১৯ সালে আমেরিকার কয়েকটি ব্রিটিশ উপনিবেশে সর্বপ্রথম ১০০ শেতাঙ্গ শিশুকে দাস হিসেবে আনা হয়। এর প্রায় চার মাস পর কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের প্রথম জাহাজটি আমেরিকায় পৌঁছায়। অবশ্য ইতিহাসবিদরা এসব শেতাঙ্গ শিশুদেরকে দাস হিসেবে মানতে রাজি ছিল না। বরং এদেরকে তারা ‘চুক্তিভিত্তিক কর্মী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
শেতাঙ্গ এসব দাসদের শ্রমের বিনিময়ে ধনসম্পদ ও অধিকার আদায়ের সুযোগ ছিল, অনেক ইতিহাসবিদই মনে করেন। যদিও শেতাঙ্গ দাসদের বেশিরভাগই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অবর্ণনীয় নির্যাতনের কারণে মারা যেত। এসময় আমেরিকায় হাজার হাজার শেতাঙ্গ দাস রপ্তানি হয়েছে। যাদের মধ্যে নারী, এমনকি শিশুও ছিল।
কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ দাসের উপর সমানভাবে নির্যাতন চলতো। দাস মালিকরা সবচেয়ে জঘন্য উপায়ে তাদির শাস্তি দিতো। নিজের হাতে ফাঁসি কার্যকর করতো, শাস্তি হিসেবে হাত ও পা পুড়িয়ে ফেলতো। কোনো কোনো শেতাঙ্গ দাসকে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে এবং বাজারে বিক্রির সময় তাদের মাথার উপর বর্শা ধরে রাখা হতো। এর মাধ্যমে তারা অন্যান্য বন্দিদের সতর্ক করতো। এসব শেতাঙ্গ দাসদের সবাই ছিল আইরিশ।
ব্রিটেনের রাজা ষষ্ঠ জেমস ও রাজা প্রথম চার্লস আইরিশদের দাস হিসেবে বিক্রি করার এ নিয়ম চালু করেছিলেন এবং পরবর্তীতে লর্ড অলিভার ক্রোমওয়েলও এ ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন। রাজা ষষ্ঠ জেমস ৩০ হাজার আইরিশ বন্দিকে নিউ ওয়ার্ল্ডের (ব্রিটিশরা যখন পৃথিবীর পশ্চিমাঞ্চলে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত করছিল, তখন তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’। যেটি এখন ‘আমেরিকা’ নামে পরিচিত) কাছে দাস হিসেবে বিক্রি করে আইরিশ দাস বাণিজ্য শুরু করেন।
পশ্চিম ভারতীয় দীপপুঞ্জে (ওয়েস্ট ইন্ডিজ) বসবারসরত ইংরেজদের কাছে ১৬২৫ জন আইরিশ রাজনৈতিক বন্দিকেও দাস হিসেবে বিক্রির ঘোষণা দেন জেমস। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে অ্যান্টিগা ও মন্টসেরাতের দাসদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল আইরিশরা। এমনকি এই সময় মন্টসেরাতের মোট জনসংখ্যার ৭০ ভাগই ছিল আইরিশ দাস।
অতি দ্রুতই ইংরেজ বণিকদের কাছে দাসদের অন্যতম উৎসে পরিণত হলো আয়ারল্যান্ড। নিউ ওয়ার্ল্ডের প্রথমদিকের দাসদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল শেতাঙ্গ আইরিশ। ১৬৪১ থেকে ১৬৫২ সালের মধ্যে ইংরেজরা প্রায় পাঁচ লাখ আইরিশদের হত্যা করে এবং ৩০ হাজার বন্দিকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। মাত্র এক দশকেই আয়ারল্যান্ডের জনস্যংখ্যা ১৫ লাখ থেকে নেমে দাঁড়ায় মাত্র ছয় লাখে। আইরিশ নাগরিকদের মধ্যে যখন বাবাদেরকে ব্রিটিশরা আমেরিকায় নিয়ে যেত, তখন তাদের সঙ্গে তাদের স্ত্রী-সন্তানদের নিতে দিতো না।
ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য ছিল, পরে বাড়িহীন অসহায় এসব আইরিশ নারী ও শিশুদেরকেও দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া। ১৬৫০ সালের মধ্যে এক লাখেরও বেশি আইরিশ শিশুকে তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পশ্চিম ভারতীয় দীপপুঞ্জ, ভার্জিনিয়া ও নিউ ইংল্যান্ডে বসবাসরত ইংরেজদের কাছে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয় ব্রিটিশরা। ১৭ শতকের পঞ্চাশের দশকে অন্তত ৫২ হাজার আইরিশকে ভার্জিনিয়া ও বার্বাডোসে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়, যাদের বেশিরভাগই ছিল নারী ও শিশু।
১৬৫৬ সালে লর্ড ক্রোমওয়েল দুই হাজার আইরিশ শিশুকে জ্যামাইকায় বসবাসরত ব্রিটিশ নাগরিকদের কাছে দাস হিসেবে বিক্রির আদেশ দেয়। অনেকেই এখন এসব আইরিশদের দাস হিসেবে স্বীকার করে না। তবে ১৭ ও ১৮ শতকে তাদের অবস্থা ছিল মানুষরূপী গৃহপালিত পশুর মতোই। ১৭ শতকের শুরুর দিকে শেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ দাস বাণিজ্য প্রায় একইসঙ্গে শুরু হয়েছিল এবং কৃষ্ণাঙ্গ দাসরা ছিল শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় বেশি ব্যয়বহুল।
এমনকি আইরিশ দাসদের তুলনায় আফ্রিকান দাসদের প্রতি ভালো ব্যবহার করা হতো। ১৭ শতকের শেষ দিকে আফ্রিকান দাসরা ছিল অনেক ব্যয়বহুল (৫০ স্টার্লিং পাউন্ড), যেখানে আইরিশ দাসদের দাম ছিল সর্বোচ্চ ৫ স্টার্লিং পাউন্ড। কম দাম হওয়ায় তাদের হত্যায়ও মালিকদের বেশি ক্ষতি হতো না বা তাদের হত্যাকে বড় অপরাধ হিসেবেও বিবেচনা করা হতো না।
এক পর্যায়ে আইরিশ নারী ও শিশুদের ভালোভাবে খাওয়া-দাওয়া দিতে শুরু করল ইংরেজরা। এতে তাদের দুইদিক দিয়ে ‘লাভ’ হলো। এসব নারীদের দিয়ে তারা নিজেদের যৌন ক্ষুধাও মেটাত, আবার তাদের দিয়ে উৎপাদনও বাড়তো। যদি কখনো কোনো নারী দাসত্ব থেকে মুক্তিও পেত, তারপরও দেখা যেত তার সন্তানরা এখনো দাস হিসেবে রয়ে গেছে। অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এসব আইরিশ নারীরা সন্তানের মায়া না ছাড়তে পেরে পুনরায় দাসত্ব গ্রহণ করতো।
পরে ইংরেজরা আইরিশ নারী ও আফ্রিকান পুরুষদের ব্যবহার করে আরো বেশি মুনাফা অর্জন করতে চাইল। তারা আইরিশ নারী ও আফ্রিকান পুরুষদের দিয়ে বেশি বেশি সন্তান উৎপাদন করত, যাতে নতুন করে অর্থ খরচ করে তাদেরকে আর দাস ক্রয় করতে না হয়। আবার আইরিশ-আফ্রিকান সংমিশ্রণে যেসব শিশু জন্মলাভ করতো, তাদের দামও ছিল অনেক চড়া। এ ধারা কয়েক দশক পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
১৬৮১ সালে বাণিজ্যিক স্বার্থে এভাবে সন্তান উৎপাদনকে নিষিদ্ধ করে একটি আইন পাশ হয়। তবে এই আইনের পেছনের মূল ঘটনা হচ্ছে, স্থানীয় ইংরেজরা এভাবে সন্তান উৎপাদন করতে থাকায় একটি বৃহৎ দাস পরিবহন কোম্পানির আয় কমে যাচ্ছিল। আইনটি বাস্তবায়নের পেছনে এ কোম্পানিটির হাত ছিল।
ইংরেজরা এক শতাব্দী ধরে আইরিশদের দাস হিসেবে বিক্রির ধারা চালু রেখেছিল। ইতিহাস বলে ১৭৯৮ সালের আইরিশ বিপ্লবের পরও হাজার হাজার আইরিশকে আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়ায় দাস হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছিল ব্রিটিশরা। আফ্রিকান ও আইরিশ দাসদের প্রতি ভয়ানক আচরণ করেছে ইংরেজরা। একবার আটলান্টিক মহাসাগরে ১৩০০ বেশি দাসকে জাহাজ থেকে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, যাতে জাহাজের ক্রুদের খাবারের সঙ্কট না হয়।
১৮৩৯ সালে অবশেষে ব্রিটেন দাস পরিবহনের মতো এ ঘৃণ্য কাজ থেকে সরে আসে। অবশ্য জলদস্যুরা তারপরও এ কাজে লিপ্ত ছিল। পরে নতুন আইনের মাধ্যমে আইরিশদের এ দুঃখ আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে আসে। তবে কেউ যদি মনে করে দাসপ্রথা শুধু কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যেই ছিল, তা হবে পুরোপুরি ভুল। আইরিশদের দুর্দশাকে তাহলে খাটো করে দেখা হবে। আইরিশদের এ দুর্দশরা কথা অবশ্যই ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থানের যোগ্য।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭১৮
আপনার মতামত জানানঃ