গুম, খুনের এ পরিবেশে সমাজকে একটা ভয়ের চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মানবাধিকারকর্মীরা। তারা বলছেন, আগে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে এ নিয়ে কাজ করতে ভয় ছিল না। এখন কাউকে তুলে নিয়ে গেলে সে বিষয়ে কাজ করার সাহস তারা পাচ্ছেন না। গুম, খুনের এ পরিবেশে সমাজকে একটা ভয়ের চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে।
আজ শনিবার(২৭ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজিত মানবাধিকার সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) নামের একটি সংগঠন এ সম্মেলনের আয়োজন করে। সংগঠনটির অষ্টম এ মানবাধিকার সম্মেলনে এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘গুম-খুন-নির্যাতনে আর চুপ নয়, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরে ভয়কে করব জয়’।
সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমরা এমন একটা সমাজে বাস করি, মুনিয়ার মৃত্যু হত্যা নাকি আত্মহত্যা, নাকি প্ররোচিত হত্যা—এটা নিয়ে নানা কারণে আমরা খুব একটা কথা বললাম না। আজকে মুনিয়া, কাল তো আমিও হতে পারি। পরশু তো আরেকজন হতে পারে।’ যখন অধিকারের বিষয়টা সর্বজনীন দায়িত্বে পরিণত হয়, তখন অধিকার আদায় করা সহজ হয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সংবিধান অনুযায়ী জনগণ সব ক্ষমতার উৎস হলেও এ চর্চা হচ্ছে না উল্লেখ করে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘এটা চর্চা না করতে করতে এমন অবস্থা করেছি যে ওরা যা ইচ্ছা তা করে ফেলতে পারে। বইয়ের ভাষা দিয়ে সব সময় আন্দোলন হয় না।’ তাই মানবাধিকারকর্মীদের মাঠে নামার পরামর্শ দেন তিনি।
এ সময় মানবাধিকারকর্মীদের এক প্রশ্নের জবাবে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘সুশীল সমাজ কথা বলতে বলতে “আয়নাঘর” উন্মোচিত হয়েছে। সুশীল সমাজের যেভাবে বলার কথা ছিল, অনেক জায়গায় আমরাও ব্যর্থ হয়েছি, অনেক জায়গায় সিস্টেম আমাদের ব্যর্থ করেছে। কিন্তু আমাদের বলতে হবে।’
আয়োজক সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা মানবাধিকারকর্মী নুর খান বলেন, “‘আয়নাঘর” নিয়ে যে কথাগুলো বলা হচ্ছে, গুম অবস্থা থেকে যারা ফিরে এসেছেন, তাদের অনেকে একই কথা বলেছেন। অনেকে আবার এখন পর্যন্ত কথাই বলেননি।’
তিনি বলেন, ‘এই বিষয়গুলো নিয়ে মানবাধিকারকর্মী বা সুশীল সমাজের একটি অংশের যেভাবে সোচ্চার হওয়ার কথা ছিল, তারা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কারণে এ নিয়ে কথা বলছেন না। আগে যেখান থেকে প্রতিবাদ হতো—সাংস্কৃতিক কর্মী বা শিক্ষক, সেই জায়গা থেকে সেভাবে প্রতিবাদ হচ্ছে না। এই প্রশ্নগুলো কিন্তু আসছে।’
একসময় এ ধরনের নির্যাতনের ব্যাপারে কথা বলতে পেরেছেন উল্লেখ করে নুর খান বলেন, ‘তখন তারা নির্যাতনের বিষয়ে পরিবার, থানা, কোর্ট-কাছারিতে দৌড়াতে পেরেছেন। তখন এতটা ভয় ছিল না। এখন যখন খবর আসে অমুককে তুলে নিয়েছে, আমরা ভয়ে ভয়ে কোনো সাংবাদিকের মাধ্যমে খবর নেওয়ার চেষ্টা করি। বড়জোর সাহস সঞ্চয় করে জেলা পর্যায়ের কোনো অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। সেই সাহসটাও হারিয়ে ফেলেছি। কারণ, তাদের এত বেশি অসহযোগিতা, এত ভয়ার্ত একটা পরিবেশের মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে।’
যখন খবর আসে অমুককে তুলে নিয়েছে, আমরা ভয়ে ভয়ে কোনো সাংবাদিকের মাধ্যমে খবর নেওয়ার চেষ্টা করি। বড়জোর সাহস সঞ্চয় করে জেলা পর্যায়ের কোনো অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। সেই সাহসটাও হারিয়ে ফেলেছি। কারণ, তাদের এত বেশি অসহযোগিতা, এত ভয়ার্ত একটা পরিবেশের মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে।’
গুম, খুনের এ পরিবেশ সমাজকে একটা ভয়ের চাদরে ঢেকে ফেলেছে বলে উল্লেখ করেন নুর খান। ‘বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি’ সে জায়গা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য শুধু বইয়ের ভাষা দিয়ে সমাধানের পথে যেতে পারবেন কি না, এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে শুধু বইয়ের ভাষা এখানে অচল বললেই চলে।
নুর খান বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, বাংলাদেশে এখন সবাই সফট ইস্যুতে ব্যস্ত; যে বিষয় নিয়ে কথা বললে কোনো সমস্যা হবে না, কেউ বিরাগভাজন হবে না, জেলে যেতে হবে না। কিছু বিষয় আছে যে কথা বললেই টুঁটি চেপে ধরবে, কথা বললেই নিবন্ধন বাতিল হবে, কথা বললেই আর কাজ করতে দেওয়া হবে না।’
ভয়কে জয় করেই যুবসমাজকে এগিয়ে যেতে হবে বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মী নুর খান। তিনি বলেন, ‘ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য, মানবিকতা প্রতিষ্ঠার জন্য ও রাজনীতিতে নৈতিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য ভয়কে জয় করেই এগিয়ে যেতে হবে।’
আইনের চোখে যাদের শিশু মনে করা হয়, তাদের বিরুদ্ধেও এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হচ্ছে বলে সম্মেলনে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) নির্বাহী পরিচালক সারা হোসাইন। তিনি বলেন, শিশু আইনে গুরুতর কোনো অপরাধ না হলে তাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা আছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কোনোভাবেই একটি বক্তব্যকে গুরুতর বলা যায় না, এরপরও প্রমাণ হওয়ার আগপর্যন্ত, বিচার হওয়ার আগপর্যন্ত, মাসের পর মাস আটক করে রাখার ঘটনা ঘটছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৩৫
আপনার মতামত জানানঃ