চার বছরের কাজ দশ বছরেও শেষ হয়নি। এদিকে, প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ২ হাজার ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। মেয়াদ বাড়ায় প্রকল্পের ব্যয় এখন দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এটা আরও বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। যুক্তি দেখানো হচ্ছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সঙ্কটের কারণে খুঁড়িয়ে চলছে প্রকল্পের কাজ।
দশ বছর ধরেই প্রকল্পটি নগরবাসীর কাছে নরক যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে। গাজীপুর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আধা ঘণ্টার রাস্তা এখন তিন ঘণ্টায়ও পার হওয়া যায় না। একদিকে প্রশস্ত রাজপথ কেটেকুটে খানাখন্দকে পরিণত করা হয়েছে। অন্যদিকে ধুলার দাপটে চলাই দুষ্কর। এ ধরনের একটি প্রকল্পে যে ধরনের মান বজায় রাখার কমপ্লায়েন্স রয়েছে সেটা লঙ্ঘন করা হচ্ছে, কোন কিছুর তোয়াক্কা নেই। প্রকল্পটির দেখার যেন কেউ।
সার্বিক দায়-দায়িত্ব প্রকল্প ব্যবস্থপনা পরিচালকের থাকলেও তিনিও সেগুলো অমান্য করে চলছেন। তার মনোভাবও বেপরোয়া। তাকে এ প্রকল্প নিয়ে মোটেও চিন্তিত দেখা যায়নি। বরং ভুক্তভোগী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত তার জন্যই প্রকল্পে এত অনিয়ম আর অবহেলা। গাজীপুর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ধূলির দাপটে মানুষের পক্ষে চলা দায়। এটা দেখেও প্রতিকার নেয়া হয় না। প্রতিদিন পানি ছিটালেই সুন্দরভাবে ধূলি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। সেটা করা হয় না। প্রকল্পটি ধূলির জন্য যেই বরাদ্দ রয়েছে- সেটা আত্মসাত করা হয়।
সাধারণত এ ধরনের প্রকল্পে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে কাজ করতে হয়। যার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না এখানে। এখানে হেলপার ক্রেন চালায়। পিয়ন দিয়ে করা হয় মাপঝোকের কাজ। লুটপাট করার জন্য দক্ষ জনবলের কাজ করানো হচ্ছে অদক্ষ দিয়ে। এমন সব অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণেই গত সোমবার ঘটে যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা। হেলপার দিয়ে ক্রেন চালানোর সময় গার্ডার ছিটকে পড়ে চলন্ত প্রাইভেট কারের ওপর।
পরিণতিতে ঘটনাস্থলেই এক পরিবারের ৫ জনকে প্রাণ দিতে হয়। তার পরই বেরিয়ে আসতে থাকে প্রকল্পটির পরতে পরতে থাকা নানা দুর্নীতি অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের সব অজানা অধ্যায়। এতে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজেই মুখ খুলতে বাধ্য হন। তিনি তদন্ত করে প্রকল্প ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন।
সোমবারের দুর্ঘটনার পর বিআরটির নানা অব্যবস্থাপনা ফাঁস হতে থাকে। ওই সড়ক ব্যবহারকারীরাও এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের মন্তব্য করে ঝড় তোলে। আর ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম তো আরও ক্ষুব্ধ হয়ে বিআরটির সব প্রকল্পেরই কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। আজ শনিবার এ বিষয়ে নগর ভবনে জরুরী বৈঠক ডেকেছেন- যেখানে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সব প্রতিনিধিকে থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন।
অথচ প্রকল্পটি ছিল অনেক স্বপ্ন ও আবেগের। ঢাকা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত যানজট কমানোর লক্ষ্যেই বিআরটি হাতে নেয়া হয়। জানা গেছে, শুরু থেকেই প্রকল্পটি নিয়ে নাানা জটিলতা দেখা দেয়। যেখানে গত দশ বছর ধরেই ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে চলাচলকারীদের কাছে অসহনীয় দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক দশক ধরেই চলছে সীমাহীন ভোগান্তি ও নরক যন্ত্রণা।
কবে নাগাদ এই অভিশাপ থেকে পরিত্রাণ মিলবে সেটাও এখনও নিশ্চিত করতে পারছে না প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তার অবহেলা অদক্ষতা আর উদাসীনতার দরুনই বিআরটি এখন পরিণত হয়েছে অভিশাপে। যার সর্বশেষ সংস্করণ ঘটে গত সোমবার। হেলপার দিয়ে গার্ডার তোলার সময় তার নিচে চাপা পড়ে একটি প্রাইভেটকারের পাঁচজন আরোহী নিহত হন। এর আগেও এখানে গার্ডার দুর্ঘটনা ঘটেছিল দুটি- যাতে একজন নিহত হন। গত এক দশকে এ রকম বড় দুর্ঘটনা তিনটি ঘটলেও কারোর কোন মাথাব্যথা ছিল না। সড়ক বিভাগও রহস্যজনক কারণে নির্বিকার। এ সড়কটি এখন বড় আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। এ রকম দুর্ঘটনা দেখে পথ চলতে আতঙ্ক বোধ করছেন তারা। এই প্রকল্পে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ রয়েছে শুরু থেকেই।
জানা গেছে, প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপন হয় ২০১২ সালে। প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালে। গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট’ প্রকল্পের (বিআরটি, গাজীপুর-এয়ারপোর্ট) আওতায় প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে গাজীপুর থেকে শাহজালাল বিমানবন্দর পর্যন্ত। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ উত্তরা হাউজ বিল্ডিং হতে টঙ্গী চেরাগ আলী মার্কেট পর্যন্ত এলাকার সড়কের কাজ করছে। বাকিটা হচ্ছে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের অধীনে।
চীনের তিনটি এবং বাংলাদেশের একটি কোম্পানি এই প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে। এর মধ্যে উড়াল সড়ক ও নিচের সড়ক নির্মাণের কাজ পেয়েছে চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ কর্পোরেশন (সিজিজিসি), জিয়াংশু প্রভিনশিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ এবং ওয়েহেই ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক এ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেটিভ। আর গাজীপুরে বিআরটির ডিপো নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে দেশীয় কোম্পানি সেল-ইউডিসি। গার্ডার দুর্ঘটনা উত্তরার যে এলাকায় ওই দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেই অংশের বিআরটির কাজ করছে ঠিকাদার কোম্পানি সিজিজিসি। ওই ঘটনায় নিহতদের পরিবারের দায়ের করা মামলায় সিজিজিসি কর্তৃপক্ষকেও আসামি করা হয়েছে।
২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ চলতে থাকায় ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়ক এখন অসংখ্য খানাখন্দে ভর্তি। মাঝরাতেও যানজটে আটকে থাকতে হয় যাত্রীদের। খানাখন্দে ভরা এ সড়কে নিরাপদে যাত্রী পরিবহন করাই পরিবহন চালকদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিমানবন্দরে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। আর দুর্ভোগেরও শুরুও এখানেই। কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। এক পাশে বালুর ঢিবি, অন্য পাশে মাটি খুঁড়ে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে এঁকেবেঁকে চলছে গাড়ি। উত্তরা রাজলক্ষ্মী পার হয়ে কিছু জায়গায় প্রকল্পের কাজ চলছে। আজমপুর থেকে আবদুল্লাহপুর ব্রিজ পর্যন্ত উড়াল সড়কের স্লাব বসানোর কাজ প্রায় শেষ। এখন মূল কাজ চলছে আবদুল্লাহপুর ব্রিজে। দুই পাশ দিয়ে সরু বিকল্প পথে চলছে গাড়ি।
বিভিন্ন জায়গায় খুঁড়ে পিলারের জন্য রড বসানো হচ্ছে। মাটির ঢিবি, বালুর স্তূপে দখল সড়কের জায়গা। এর সঙ্গে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, রডসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী রাখা হয়েছে সড়কের মাঝে। দিনের অধিকাংশ সময় যানজট লেগে থাকে গুরুত্বপূর্ণ এ পয়েন্টে। রাত গভীরে দেখা যায় যানের শম্বুকগতি। যানজটে অচল থাকে শেষ রাতেও। দেখা যায়- চারদিকে গায়ে গায়ে লেগে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি। চৌরাস্তার সরু জায়গায় গাড়ির চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। তীব্র রোদে, গরমে যানজটে যাত্রীদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। এর সঙ্গে ধুলা আর গাড়ির হর্নে অসহনীয় অবস্থা। বছরের পর বছর ধরে এ প্রকল্পের কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এ পথে চলাচলকারী ২১ জেলার যাত্রীদের।
সর্বশেষ জানা গেছে, বার বার পেছানো হচ্ছে এর শেষ করার সময়সীমা। বহুল প্রতিক্ষীত এই প্রকল্পটির কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে না পারায় সর্বশেষ মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু আসছে ডিসেম্বরে শেষ করা কিছুতেই সম্ভবপর হবে না সেটা প্রকল্প এমডি সফিকুল ইসলাম নিজেই স্বীকার করেন দৈনিক জনকণ্ঠের কাছে। বলেছেন- এখন পর্যন্ত ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন আশা করা যাচ্ছে আগামী মার্চে কাজ শেষ হয়ে যাবে। প্রকল্পের সময় আগামী বছরের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আর জুনে খুলে দেয়া হবে জনগণের জন্য।
বিআরটি প্রকল্প পরিচালক এএসএম ইলিয়াস শাহ বলেন, বাকি কাজ ডিসেম্বরে হবে না। তাই সময় বাড়ানোর জন্য সংশোধন করতে হবে। পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
এমডি সফিকুলের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত সম্পন্ন হওয়া ৭০ ভাগ কাজে সময় লেগেছে দশ বছর। বাকি কাজ কিভাবে সম্ভব চার মাসে? বাস্তবে এখনও এমন কিছু কাজ রয়ে গেছে যা শুরুই করা হয়নি। গাজীপুর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত অনেক স্থানে পাইলিং শুরুই করা হয়নি। যা আগামী এক বছরেও করা সম্ভব হবে না।
এদিকে প্রকল্পটির দীঘসূত্রতার দরুন জনদুর্ভোগের অন্ত নেই। উত্তরার রানাভোলার বাসিন্দা শহীদ উল্লাহ পাটওয়ারী বলেন, গত দশ বছর ধরেই এ রাস্তাটি কেটেকুটে খানাখন্দকে পরিণত করেছে। মানুষের উপায় নেই এখান দিয়ে চলার। যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা কি ধরনের যন্ত্রণার শিকার হচ্ছে- তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। এর মতো এত বাজে প্রজেক্ট আর আছে কি না, আমার জানা নেই।
রাস্তার মাঝখান দিয়ে বাস র্যাপিড ট্রানজিট বানাচ্ছে, কিন্তু দু’পাশের রাস্তা এত সরু করেছে যে অন্য যানবাহন চলতে পারে না। আগে কাজ চলছিল তখনও জ্যাম ছিল। এখন কাজ শেষের দিকে, জ্যাম যেন আরও বাড়ছে।
নির্মাণাধীন উড়াল সড়ক ও ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণে নেই কোন ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সারা দিন বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী ওঠানামা করছে। নিরাপত্তার ব্যবস্থা না রেখেই নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ ব্যাপারে বিআরটি প্রকল্পের প্রকৌশলী মোঃ তৌহিদুজ্জামান বলেন, ‘মূল সড়কের ওপর শতভাগ নিরাপত্তা দেয়া কঠিন। তবে আমরা যখন আই গার্ডার বসাই তখন চার-পাঁচ জন ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করেন।
যে জায়গা দিয়ে গার্ডার বসানো হয়, সেখানে গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখি। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের টঙ্গী থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার অংশে চলছে বিআরটি প্রকল্পের কাজ। এ অংশের নির্মাণ কাজের ধীরগতির কারণে তীব্র দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রী ও চালকদের।
এদিকে প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতার ব্যাপারে জানতে চাইলে স্থপতি ইকবাল হাবিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিআরটি প্রকল্পটির পরিণতি কি হবে তা নির্ণয় করা উচিত। এভাবে আর চলতে পারে না। এক দশকেও কাজটি শেষ করতে পারছে না। অব্যবস্থাপনায় ভরা। তাদের আসলে কাজে নজর নেই। জনগণকে সম্পৃক্ত করে জনগণের স্বার্থে কাজ করলে এটি আগেই শেষ হয়ে যেত। আসলে এখানে ধান্ধা চলছে।
তাই তো শেষ সময়ে আলিশান অফিস ভবনে নজর দিয়েছে। অনেক ভবন পড়ে আছে, দরকার হলে ভাড়া নিতে পারে। সরকার ব্যয় কমাতে উদ্যোগ নিয়েছে, এমন সময়ে অফিস করার কোন প্রশ্নই আসে না। উন্নয়নের নামে রাজধানীর মহাখালী থেকে বনানী হয়ে আর্মি স্টেডিয়াম পর্যন্ত সড়ক দখল করা হয়েছে। তা ফিরিয়ে দেয়া উচিত। বিভিন্ন ভবন করে নগর ধ্বংস করা হচ্ছে। তা বন্ধ করা উচিত।
একই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেছেন-‘বিআরটি প্রকল্প আর কতকাল চলতে থাকবে। ঠিকমতো কাজ হয় না। বিমানবন্দরে ঠিকমতো যাওয়া যায় না। ঠিকমতো শিপমেন্ট করা যায় না। নিয়ম থাকলেও ঠিকাদার তা আমলে নেয় না।
উল্লেখ্য, রাজধানীর যানজট নিরসনে দ্রুতগতির গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ২০১১ সালে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত নির্দিষ্ট লেনে শুধু বাস চলাচলের জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে এই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রকল্পটি অনুমোদন পায় ২০১২ সালের ২০ নবেম্বর। ব্যয় ধরা হয় দুই হাজার ৪০ কোটি টাকা।
প্রকল্পের আর্থিক সহযোগিতায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ফরাসী উন্নয়ন সংস্থা ও গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটির ঋণ হচ্ছে এক হাজার ৬৫১ কোটি টাকা। বাকি অর্থায়ন সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে দেয়া হবে। প্রকল্পের বাস্তবায়ন সময় ধরা হয় ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত। ঋণদাতা সংস্থার সঙ্গে ২০১২ ও ২০১৩ সালে ঋণচুক্তিও হয়েছে। এরপর শুরু হয় কাজ। ডিপিপি চার দফা সংশোধন করায় ব্যয় ও সময় বাড়ে। বাড়তি ব্যয় মেটাতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে ম্যানেজ করতে হয়েছে ৩ হাজার ১৬২ কোটি টাকা।
এই প্রকল্পের জন্য ১ দশমিক ৯০ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও বাস মালিকদের ক্ষতিপূরণ ছাড়াও ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার ডেডিকেটেড বাস লেন, ১০ লেন বিশিষ্ট টঙ্গী সেতু, ৪ দশমিক ৫০ কিলোমিটার এলিভেটেড সড়ক, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ইন্টারসেকশনে ৫৫০ মিটারের আন্ডারপাস, ৬টি ফ্লাইওভার, একটি বাস ডিপো, উভয় পাশে ১২ কিলোমিটার করে ড্রেন নির্মাণের কথা উল্লেখ রয়েছে।
এ ছাড়া যাত্রী বহনে ৫০টি আর্টিকুলেটেড বাস ক্রয়, ৯টি জীপ গাড়িসহ ১২টি যানবহন ক্রয়, ৪টি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতাও রয়েছে। নতুন করে সংশোধনী প্রকল্পে ১৩০টি আর্টিকুলেটেড বাস কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের শুরুতে ৫০টি আর্টিকুলেটেড বাস কেনার প্রস্তাব করা হয়েছিল।
এদিকে প্রকল্পটি দীর্ঘসূত্রতায় যে ধরনের জনদুর্ভোগ চলছে তার প্রতিও নেই কারোর কোন নজর। একদিকে ভোগান্তি, অন্যদিকে নিরাপত্তাহীন অবস্থায় চলছে কাজ। এ সম্পর্কে উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা ইব্রাহিম খলিল রেজা বলেন- প্রতিদিন আমি এখান থেকে মহাখালীতে অফিস করতে যাই। সকালে সেক্টর থেকে বেরিয়ে যখনই রাস্তায় উঠি তখনই শুরু হয় নরক যন্ত্রণা। ঢাকা-ময়মনসিংহে রুটের এই রাজপথের মাঝখানটায় ইটবালু সিমেন্ট, গার্ডার, স্লাব, পাথরের স্তূপ। দু’পাশে সরু রাস্তায় কোনক্রমে চলে গাড়ি।
আবার কোথাও কোথাও বিআরটির কাজ চলার কারণে রাস্তার একদিকে বন্ধ থাকে। চলাচলের রাস্তা সঙ্কীর্ণ, আর উঁচু-নিচু, ফলে বাসগুলো চলাচলের সময় অনেকটাই হেলে যায়। সেদিন দেখলাম একটা গাড়ি পড়ে গেছে। কোনক্রমে অন্য গাড়িও চাপা পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু চালকের প্রত্যুৎপন্নমুতিতার কারণে বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়। তিনি বলেন- অনেক সময় জ্যামে আটকা পড়লে বাসের ওই হেলান অবস্থাতেই থাকতে হয়। এটা খুবই বিপজ্জনক। কিছুদিন আগে এয়ারপোর্ট রোডেও এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। সেখানে কাজ চলছিল, হঠাৎ করেই একটা স্প্যানের অর্ধেক খুলে গিয়ে নিচে পড়েছিল। সেটা অল্পের জন্য আমাদের বাসের ওপর পড়েনি।
গোলাম সাত্তার রনি নামের আশকোনার এক বাসিন্দা বলেন- আমি প্রতিদিন তেজগাঁওয়ে আসা-যাওয়া করি। নিয়মিত বনানী থেকে উত্তরায় যাওয়া-আসা করেন। বনানী থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ভালভাবেই আসা যায়। এয়ারপোর্ট থেকে উত্তরা হাউস পর্যন্ত একটা রাস্তার দুই পাশেই খুঁড়ে রেখেছে। ফলে ভোগান্তি হচ্ছে। আমি এতটুকু বলতে পারি, এখানে পরিকল্পনামাফিক কোন কাজ হচ্ছে না। ঢাকার বাইরে অন্যান্য এলাকায় যেতে অনেক ক্ষেত্রে এই রাস্তাটাই একমাত্র ওয়ে। অথচ মানুষ প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই রাস্তাটা দিয়ে যাচ্ছে। কারও কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
উত্তরার অপর বাসিন্দা মুর্শিদ সোমবারের দুর্ঘটনা নিয়ে তিনি বলেন- আজকের ওই দুর্ঘটনার পর আমি আপসেট। গত পরশু আমি নিজেই জসীমউদ্দীন সড়ক দিয়ে মতিঝিল যাওয়ার সময়ে দেখলাম ওই গার্ডারগুলো। রাস্তা দিয়ে একের পর এক গাড়ি চলছে। আবার অন্যদিকে গার্ডার তোলার দৃশ্য। ভয় লেগেছে দেখে। মাসুদ নামের এক তরুণ বলেন- সোমবার দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই সেই পথে বাসে এসেছিলাম। ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই আমি বাসে সেই রাস্তা দিয়ে এসেছি। বাসায় এসেই শুনলাম এই ঘটনা। এটা তো আমার সঙ্গেও ঘটতে পারত। এমন অজানা আশঙ্কা নিয়েই প্রতিদিন চলতে হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এসএস/০৮১৫
আপনার মতামত জানানঃ