চল্লিশ হাজার বছর আগে ইউরোপে আমরাই একমাত্র মানব প্রজাতি ছিলাম না। আরও তিন প্রজাতির বাস ছিলো তখন। মানুষের এই প্রজাতিগুলোর মধ্যে বর্তমান মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি সময়ের প্রজাতি হচ্ছে নিয়ান্ডারথাল। ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৩ লক্ষ বছর আগে তারা বাস করত। আজ থেকে প্রায় ৩০ বা ৪০ হাজার বছর আগে এ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় তারা।
আজ থেকে ৪০ বা ৪২ হাজার বছর আগে পৃথিবীর মেরুদ্বয়ের প্রান্ত বদলের কারণেই অতিকায় স্তন্যপায়ী প্রজাতি মেগাফনা ও নিয়ান্ডারথাল মানবরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। নিয়ান্ডারথাল প্রজাতি প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানবজাতির সঙ্গে কতটা সাদৃশ্যপূর্ণ, তা নিয়ে এখনো রয়েছে নানা বিতর্ক।
নিয়ান্ডারথালদের পাশাপাশি পাওয়া গেছে তিব্বতের অত্যন্ত উঁচু স্থানে মানুষের আদিম একটি প্রজাতি ‘ডেনিসোভান’দের বসবাসের প্রমাণ। চরম প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষমতা একমাত্র বর্তমান মানব প্রজাতি- হোমো স্যাপিয়েন্স-এর সাথেই এটি যুক্ত ছিল।
আধুনিক মানুষের প্রাচীন এই পূর্বপুরুষ থেকে একটি জিন বর্তমান প্রজাতিতে এসেছে যার মাধ্যমে আধুনিক মানুষ অনেক উঁচু কোনও স্থানে টিকে থাকার ক্ষমতা পেয়েছে। এ নিয়ে নিবন্ধের বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়েছে বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী ‘নেচার’-এ।
ডেনিসোভানরা ছিল মনুষ্য প্রজাতিগুলোর মধ্যে একটি রহস্যময় প্রজাতি, যারা এখনকার আধুনিক মানুষের আগে এশিয়ায় বসবাস করতো। ধারণা করা হয়, হাজার বছর আগে তারা পৃথিবীর অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে পর্যন্ত সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা গুহাতে পাওয়া জীবাশ্ম থেকে হাড় ও দাঁতের কিছু নমুনায় এই প্রজাতি সম্পর্কে জানা যায়।
কিন্তু সেখান থেকে পাওয়া ডিএনএ থেকে জানা যায় যে এরা মানবজাতির একটি স্বতন্ত্র শাখা ছিল।
এখন বিজ্ঞানীরা অন্য একটি সাইট থেকে প্রথম ডেনিসোভা জীবাশ্ম চিহ্নিত করলো। ১৯৮০ সালে তিব্বতের মালভূমিতে ৩,২৮০ মিটার উচ্চতায় বৈশিয়া কার্স্ট গুহাতে পাওয়া যায় নিচের ডেনিসোভা প্রজাতির নিচের চোয়ালের হাড়। কার্বন টেস্টের বদলে ইউরেনিয়াম-সিরিজ ডেটিং করা হয় অস্থিগুলোর বয়স বের করার জন্যে। চোয়ালের হাড়গুলো প্রায় ১,৬০,০০০ বছরের পুরনো বলে জানা যায়।
এই গবেষণাপত্রের সহ-লেখক যিনি জার্মানির লিপজিগের বিবর্তনবাদী নৃতাত্ত্বিক গবেষণা সংস্থা ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউটে কাজ করেন, জিন জ্যাকস হাবলিন বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এতটা উঁচুতে মানুষের আদি প্রজাতির বসবাসের প্রমাণ পাওয়াতে।
তবে বিতর্ক আর বিস্ময়ের বাকি আছে অনেক। আমরা টাইলন, হোয়েলফিন, গ্রোলার কিংবা বিফেলোরের সঙ্গে অল্পবিস্তর সকলেই পরিচিত। দুটি ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর মিলনে জন্ম নেয় এই সকল হাইব্রিড জীব। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে যদি একই ঘটনা ঘটে? হ্যাঁ, অবাক লাগলেও সত্যি।
আজ থেকে প্রায় ৫০ হাজার বছর আগের কথা। নিয়ান্ডারথাল এবং ডেনিসোভা প্রজাতির মানুষের মিলনে জন্ম নিয়েছিল এমনই এক আশ্চর্য কিশোরী। অন্তত এখনও পর্যন্ত আবিষ্কার হওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে বলা যায়, এই কিশোরীই বিশ্বের একমাত্র হাইব্রিড বা শঙ্কর-মানব।
সাইবেরিয়ার একটি গুহায় গবেষকরা সন্ধান পেয়েছিলেন এই প্রাচীন মানবীর। গবেষকদের অনুমান, গুহাটিতে মূলত বসবাস করত ডেনিসোভারাই। ফলে, কিশোরীটিকেও গবেষকরা প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করেছিলেন ‘ডেনিসোভা ১১’ নামে।
তবে তার দেহাবশেষের ডিএনএ-র বিশ্লেষণেই ভুল ভাঙে গবেষকদের। সেই ডিএনএ-তে যেমন ডেনিসোভার বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তেমনই রয়েছে নিয়ান্ডারথাল-এর বৈশিষ্ট্য। অধ্যয়ন থেকে গবেষকরা সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, প্রাচীন এই কিশোরীর বাবা ছিল নিয়ান্ডারথাল ও মা ডেনিসোভা। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই মারা গিয়েছিল পৃথিবীর একমাত্র শঙ্কর-মানব।
ডেনিসোভারা মূলত বসবাস করত পশ্চিম ইউরোপীয় অংশে। অন্যদিকে নিয়ান্ডারথাল জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল পূর্বে। এই দুই জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বই বজায় ছিল আজ থেকে ৪০ হাজার বছর আগে পর্যন্ত। তারপর এই দুই প্রজাতিকেই প্রতিস্থাপিত করে আধুনিক মানুষ। তবে ‘ডেনিসোভা ১১’-এর দেহাবশেষ প্রমাণ করে সে-সময় দুই ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির মানুষদের মধ্যে শুধু সংঘাতই নয়, যোগাযোগও ছিল বিস্তর।
অসবর্ণ বিবাহের সঙ্গে আজকে সকলেই পরিচিত আমরা। তা নিয়ে বিতর্কেরও অবকাশ নেই এতটুকু। কিন্তু আজ থেকে ৫০ হাজার বছর আগে অনেকটা এমনই ঘটনা ঘটেছিল ইউরেশিয়ায়—তা ভাবলেও অবাক হতে হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/২০৩২
আপনার মতামত জানানঃ