শুধু জলদস্যুই নয়, যৌনব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল এই শহর। স্পেন থেকে শুরু করে ব্রিটেন, সব শাসকের নজরে ছিল এই শহরের দিকেই। জামাইকার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে পোর্ট রয়্যাল শহরটি দখল করার জন্য শাসকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে শহরটির এতোটাই কুখ্যাতি ছিল যে অনেকে ‘পৃথিবীর নিকৃষ্টতম শহর’ বলে বিবেচনা করতো।
প্রথম দিকে এই শহর স্পেনের দখলে ছিল। ব্রিটিশ জেনারেল অলিভার ক্রমওয়েল পোর্ট রয়্যাল এলাকা দখল করতে লোক পাঠানোর পর লুঠপাটও চলে। ১৬০০ সাল নাগাদ জামাইকার এই এলাকা পুরোপুরি ইংরেজদের দখলে চলে আসে।
এমনকি, বস্টনের পর সকলে পোর্ট রয়্যাল শহরটিকে ইউরোপের উল্লেখযোগ্য স্থানগুলর মধ্যে অন্যতম বলে মনে করতেন। বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ শহর হিসেবে পরিচিতি ছিল পোর্ট রয়্যালের। জলদস্যু ও যৌনব্যবসায়ীরা পোর্ট রয়্যালের মূল আকর্ষণ হলেও এখানে ইংরেজরা ভিড় জমাতেন আরো একটি কারণে।
এই শহরে যারা থাকতেন, তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল দাস শ্রেণির। এই শহর থেকে দাস কেনাবেচা করতেন ব্রিটিশরা। ১৬৬২ সালে পোর্ট রয়্যাল শহরের জনসংখ্যা ৭৪০ হলেও তিন দশক পর এখানকার জনসংখ্যা এক লাফে বেড়ে ১০ হাজারের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়। এই জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ দাস ছিলেন।
বস্টনের পর সকলে পোর্ট রয়্যাল শহরটিকে ইউরোপের উল্লেখযোগ্য স্থানগুলর মধ্যে অন্যতম বলে মনে করতেন
বস্টনের পর সকলে পোর্ট রয়্যাল শহরটিকে ইউরোপের উল্লেখযোগ্য স্থানগুলর মধ্যে অন্যতম বলে মনে করতেন।
ইতিহাসবিদদের মতে, ১৬৫৫ সালে এক ইংরেজ বাহিনী জ্যামাইকা আক্রমণের পর এটিকে দ্রুত পয়সা বানানোর স্থানে পরিণত করে। তবে ইংরেজ জনবলের অভাবে দ্বীপটি রক্ষায় তত্কালীন গভর্নর এডওয়ার্ড ডি উইলি সেখানে জলদস্যু ও প্রাইভেটিয়ারদের (ভাড়াটে যোদ্ধা) একটি জোটকে নিয়োগ দিতে বাধ্য হন।
পরবর্তীতে তারা দাস ব্যবসা, চিনি ও কাঠের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পোর্ট রয়্যালকে অ্যালকোহল, অর্থ আর যৌনতার এক বিকারগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর আশ্রয়স্থলে পরিণত করে। সেসময় শহরটির এক-চতুর্থাংশ ভবন বার ও যৌনপল্লী হিসেবে গড়ে ওঠে এবং শহরটিতে দ্রুত পয়সাওলা লোক বাড়তে থাকে। জলদস্যুদের অসম্ভব লোভ আর ব্যভিচার দ্রুতই শহরটিকে ‘বিখ্যাত’ করে তোলে। আমোদ উল্লাসে ভরপুর জীবনযাত্রার ব্যয় বহনে তারা ওই অঞ্চলের দুর্বল স্প্যানিশ বন্দরগুলোতে আক্রমণ ও লুণ্ঠন করতে থাকে।
এই জলদস্যুরা আক্ষরিক অর্থেই যা খুশি তাই করার মতো মুক্ত ও স্বাধীন ছিল। কারণ তাদের জ্যামাইকার রক্ষক হিসেবে দেখা হতো। স্থানীয় ইতিহাসবিদ পিটার গর্ডন বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেন- তাদের এভাবে ছেড়ে দেয়া ছাড়া কর্তৃপক্ষের আর কোনো উপায় ছিল না। তারা যা খুশি তা-ই করতে পারতো। যৌনপল্লী, পানশালা আর গির্জা সমান-সমান ছিল। তাই আপনি পোর্ট রয়্যালের রুক্ষ্ণ পরিবেশটি সহজেই কল্পনা করতে পারেন।
ইংরেজরা আসার পর এই শহরে দুই হাজারের উপর আবাসন গড়ে ওঠে। শহর জুড়ে মোট ছয়টি দুর্গও তৈরি করেছিল ইংরেজরা। সব মিলিয়ে, পোর্ট রয়্যাল শহরটি বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। কিন্তু ১৬৯২ সালের জুন মাসে পুরো শহরটি ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়। ৭ জুন সকালে ভয়ানক ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল সারা শহর। কম্পনের তীব্রতা ছিল ৭.৫। দুর্গ থেকে শুরু করে শহরের বেশির ভাগ অংশ পানির গভীরে তলিয়ে যায়।
লেফটেন্যান্ট গভর্নর হেনরি মরগ্যানের কবরও পানির নিচে মিশে যায়। শহরের বাসিন্দাদের অনেকেই এই দুর্ঘটনায় মারা যান। এই দুর্ঘটনার পর শহরে চুরি-ডাকাতির পরিমাণ বাড়তে থাকে। শুধু তাই নয়, পোর্ট রয়্যাল শহরে বার বার বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় লেগেই থাকে। আস্তে আস্তে ১৭ শতাব্দীর এই শহর ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়।
তবে এখনও ৪০ ফুট পানির নিচে এই প্রাচীন শহরের বহু চিহ্ন রয়ে গিয়েছে। ১৯৫০ সাল থেকেই ডুবুরিরা এই শহরের খোঁজ করতে পানির নিচে ডুব দিয়েছেন। ১৯৯৯ সালে এই শহরটি জাতীয় ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় যুক্ত হয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ