প্রতিদিন গড়ে অন্তত দু’জন ফিলিস্তিনি শিশুকে ধরে নিয়ে যায় ইসরায়েলি সৈন্যরা৷ জেলে পুরে চালায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন৷ প্রায় ৭ হাজার শিশুর ওপর এমন অমানবিক নির্যাতনের তথ্য জানিয়েছিল জাতিসংঘ৷
এদিকে, অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার বর্তমান পরিস্থিতি ও ইসরায়েলি আগ্রাসন নিয়ে আলোচনা করতে জরুরি বৈঠক করেছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। গত সোমবার অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে ইসরায়েলের অযৌক্তিক আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত রিয়াদ মনসুর প্রশ্ন করেন, আর কত শিশুকে কবর দিতে হবে?
তিনি প্রশ্ন তোলেন, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দায়ী সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হিসেবে জাতিসংঘ কি যথেষ্ট প্রস্তুত?
এদিকে বৈঠকের শুরুতে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে দেয়া এক বক্তব্যে জাতিসংঘ মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত টর উইনেসল্যান্ড বলেন, এ অঞ্চলে ফের যুদ্ধ শুরু হলে পরিণতি হবে ‘ভয়াবহ’।
অন্যদিকে দেশ দু’টির মধ্যে চলমান অস্ত্রবিরতির বিষয়ে তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘এ অস্ত্রবিরতি ভঙ্গুর।’
এর আগে সোমবার টানা তিন দিনের রক্তাক্ত সংঘর্ষের পর গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল। মিশরের মধ্যস্থতায় আলোচনার পর এ সিদ্ধান্ত নেয় দেশ দু’টি।
এ সময় ইসরায়েলি হামলায় পিআইজে’র দুই শীর্ষ নেতাসহ অন্তত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শিশু রয়েছে ১৫ জন। এছাড়া আহত হয়েছেন ৩৬০ ফিলিস্তিনি নাগরিক।
জাতিসংঘের বৈঠকে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভসিলি নেবানজিয়া বলেন, সেখানে আবারও সংঘাত ছড়িয়ে পড়ায় নিরাপত্তা পরিষদ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আর এই সংঘাত পুরোদমে সামরিক লড়াই ফের শুরুর ক্ষেত্রে ইন্ধন যোগাতে পারে। ফের যুদ্ধ বেধে গেলে গাজা মানবিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। ইতোমধ্যেই সেখানকার মানবিক পরিস্থিতির অনেক অবনতি ঘটেছে।
তবে জাতিসংঘের মার্কিন রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড ‘সন্ত্রাসী হুমকির বিরুদ্ধে তার জনগণকে রক্ষা করার জন্য ইসরায়েলের অধিকার’ সমর্থন করেছেন অর্থাৎ বরাবরের মতো ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
২০২১ সালের ১১ দিনের হামলার পর, তিন দিনের এ সহিংসতা ছিল গাজার সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘর্ষ। যা মিশরের মধ্যস্থতায় রোববার রাতে একটি অস্ত্রবিরতিতে পৌঁছানোর পর লড়াইয়ের সাময়িক অবসান ঘটে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, এ সংঘাতে গাজা উপত্যকায় ১৫ শিশুসহ ৪৪ জন নিহত ও ৩৬০ জন আহত হয়। এছাড়া গাজার বহু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সবশেষ ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়েছে সৌদি আরবসহ আরব বিশ্বের দেশগুলো।
ফিলিস্তিনি শিশু হত্যা
সূত্র মতে, প্রতিদিন গড়ে অন্তত দু’জন ফিলিস্তিনি শিশুকে ধরে নিয়ে যায় ইসরায়েলি সৈন্যরা৷ জেলে পুরে চালায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন৷ প্রায় ৭ হাজার শিশুর ওপর এমন অমানবিক নির্যাতনের তথ্য জানিয়েছিল জাতিসংঘ৷
সারা বিশ্বে শিশুরা যেখানে গড়ে ৬ দশমিক ৮ থেকে ১২ দশমিক ২ শতাংশ পিটিএসডিতে (পোস্ট ট্রমাটিক ডিজঅর্ডার) ভুগছে, সেখানে ফিলিস্তিনি শিশুদের মধ্যে এ হার ৩৪ দশমিক ১ থেকে ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ।
বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে ইসরায়েলি সেনাদের আগ্রাসনের ঘটনা ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোর মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বিগ্নতা ও ভীতির বোধ জন্ম নিচ্ছে। ঘর যেখানে তাদের নিশ্চয়তা আর আনন্দের উৎস হওয়ার কথা, তার বদলে ভীতি তাদের তাড়া করে ফিরছে। এর ফলাফল হচ্ছে, শিশুরা বিদ্যালয়ে যেতে আগ্রহ হারাচ্ছে, তারা চুপচাপ, বিষণ্ন কিংবা খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে।
এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালে প্রতি সপ্তাহে ইসরায়েল একজনের বেশি শিশুকে হত্যা করেছে। এর আগের এক দুঃখজনক সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছিল, ২০০০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ১৪ বছর গড়ে প্রতি তিন দিনে একটি ফিলিস্তিনি শিশুকে হত্যা করেছে ইসরায়েল।
২০১৮ সালের পর থেকে অন্ততপক্ষে ৭ হাজার ফিলিস্তিনি শিশু কিশোরকে আটক করেছে ইসরায়েল। সেইসাথে তাদের ওপর চালানো হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এর মধ্যে ২০২০ সালে ১ হাজার ৩৪৬ জন শিশুকে আটক করা হয়, ২০১৯ সালে ২ হাজার ৩৮১ জন এবং ২০১৮ সালে ৩ হাজার ২৫০ জন।
বিশ্ব সমাজের মেরুদণ্ডহীন, অকার্যকর ও নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কারণেই ইসরায়েল ফিলিস্তিনি শিশুদের হত্যা করছে চরম ঔদ্ধত্য দেখিয়ে। ইসরায়েলের জল্লাদ বা কসাই শাসকরা চরম পাশবিকতা দেখিয়ে ঘোষণা করেছে, আরও বেশি ফিলিস্তিনি শিশুদের হত্যা করা উচিত!
নেতানিয়াহু দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ৩৩১৬ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়, যার মধ্যে শিশু ৭৭৫ জন। ইসরায়েলের মানবাধিকার সংস্থা ‘বেইতসালেম’ এই রিপোর্ট দিয়েছে।
বহু স্থানে উদ্বাস্তু শিবিরে ফিলিস্তিনি শিশুদের রাখা হয়েছে, সেখানেই একবেলা খেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। মানবাধিকার সংস্থা মিজান এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে দখলদার ইহুদিবাদী ইসরায়েলি সেনাদের গুলি বর্ষণে ৫৬ ফিলিস্তিনি শিশু শহীদ হয়েছিল।
এ ছাড়াও একই বছরে ইসরায়েলি সেনাদের গুলির শিকার হয়ে আহত হয়েছে দুই হাজার ৮৯০ ফিলিস্তিনি শিশু। একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্ণবাদী ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার বিশেষ করে ফিলিস্তিনি শিশুদের অধিকার লঙ্ঘন জোরদার করে গত বছর গাজায় দু’টি স্কুলে বোমা বর্ষণ করে।
ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে দুই হাজার সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা বা গণ-অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার ৩০০ ফিলিস্তিনি শিশু ইসরায়েলি সেনাদের হাতে শাহাদত বরণ করেছে। অথচ ফিলিস্তিনি শিশুরা ইসরায়েলি সেনাদের জন্য কোনো হুমকি তৈরি করেনি।
ইসরায়েল অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি সৈন্যদের চোরাগোপ্তা হামলা, ড্রোন হামলা এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর হামলায় এই শিশুরা নিহত হয়েছে। হত্যার শিকার ৫টি শিশুর বয়স ছিল ১২ বছরের নিচে। গাজায় ৪৯ শিশুকে হত্যা করে ইসরায়েল, যারা ‘গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন’ বা দেশে ফেরার প্রতিবাদ কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিল।
মানবঢাল
জাতিসংঘের শিশু অধিকার কমিটির তৈরি এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মূলত ইসরায়েলি সেনাসদস্যদের উদ্দেশ্যে পাথর ছোঁড়ার অভিযোগে আটক করা হয়৷ শিশুদের ধরতে রাতের অন্ধকারেও চালানো হয় অভিযান৷ ধরেই শক্ত করে বাঁধা হয় হাত, চোখ– সেই অবস্থায় নিয়ে গিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য চালানো হয় নির্যাতন৷
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ইসরায়েলি সেনাদের আরেক নিষ্ঠুরতার কথা উঠে এসেছে৷ হামলায় ফিলিস্তিনি শিশুদের ব্যবহার করা হয় ‘মানবঢাল’ হিসেবে৷ কোনো ভবনে অভিযান চালাতে গেলে ফিলিস্তিনিরা যখন পাথর ছুঁড়তে থাকে, ইসরায়েলি সেনারা তখন সামনে দাঁড় করায় আটক শিশুদের, উদ্দেশ্য– ঢিল বা গুলি যাই আসুক, আঘাতটা আগে লাগবে শিশুদের গায়ে।
জেলখানার বন্দীদের নিয়ে কাজ করে- এমন এক সংগঠন ‘আদামির’ বলেছে, ফিলিস্তিনি শিশুদের পরিকল্পিতভাবে লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আদামিরের রিপোর্টে দেখা যায়, ২০১৮ সালে ৮০০ ফিলিস্তিনি শিশুকে জেরুসালেম থেকে বন্দী করা হয়। এর মধ্যে ৪১ জন পূর্ব জেরুসালেমের। তারা বছরের শেষ দিন পর্যন্ত জেলে আটক ছিল।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৫০
আপনার মতামত জানানঃ