বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মুনাফার প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা কোথায় গেল, এই প্রশ্ন এখন অনেকের। বলা হচ্ছে, ভর্তুকিতে তেল বিক্রি করে ক্রমাগত লোকসান গুনে বিপিসি প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এই পরিস্থিতি ঠেকানোর জন্য সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম গড়ে ৫০ ভাগের বেশি বাড়ানো হয়েছে।
কিন্তু খোদ সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, বিগত আট বছর ধরে বিপিসি তেল বিক্রি করে লোকসান নয়, বরং মুনাফা করেছে। এই মুনাফার পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। মুনাফার মূল কারণ ছিল ২০১৩ সালে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের মূল্য ৯৪ ডলার থেকে কমতে কমতে ২০১৬ সালে ৪০ ডলারের নিচে নেমে আসে। কিন্তু বিপিসির পক্ষ থেকে তারপরও দাম কমানো হয়নি। কেবল ২০১৬ সালের এপ্রিলে কেরোসিন ও ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ৩ টাকা কমানো হয়েছিল।
তবুও কম দামে তেল কিনে তা দেশের বাজারে প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রির কারণে বিপিসি প্রতি বছরই হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এর ফলে আট বছরে বাজেট থেকে বিপিসিকে তেল কেনা বাবদ কোনো ধরনের ভর্তুকিও সরকার প্রদান করেনি। এবারকার বাজেটেও তেল কেনা বাবদ বিপিসির নামে কোনো ভর্তুকি বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়নি বলে জানা গেছে।
জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত শুক্রবার বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেছেন, বিপিসি গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ছয় মাসে আট হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। কিন্তু খোদ অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের ২২ মে পর্যন্তও প্রতিষ্ঠানটি মুনাফায় ছিল। অর্থ্যাৎ, গেল ২০২১-২২ অর্থবছরের মে ’২২ পর্যন্ত বিপিসি মুনাফা করেছে এক হাজার ২৬৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এখনকার পরিসংখ্যান বা তথ্য সঠিক কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে, গত আট বছরে বিপিসির এই অর্ধ লাখ কোটি মুনাফার অর্থ কোথায় গেল সেটি নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। জানা গেছে, মুনাফার একটি অংশ (প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা) এক আইনি ক্ষমতাবলে অর্থ মন্ত্রণালয় নিয়ে গেছে এবং মুনাফার আরো একটি অংশ বিপিসির কিছু ‘বিলাসী’ উন্নয়ন প্রকল্পে ঢেলে দেয়া হয়েছে।
কিন্তু তারপরও মুনাফার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বিপিসির হাতে থাকার কথা। কিন্তু সেই টাকা কোথায় আছে তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছেন, বিপিসি দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এই সংস্থার কাছে এখনো অনেক টাকা গচ্ছিত রয়েছে। এই টাকা তারা ব্যাংকে ডিপোজিট করেছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে।
তিনি বলেন, হঠাৎ করে এত বেশি তেলের দাম বাড়ানো হবে সে বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো মতামত নেয়া হয়নি। আমাদের মতামত নেয়া হলে অবশ্যই আমরা এত বেশি দাম বাড়ানোর পরামর্শ দিতাম না। এই দাম ধাপে ধাপেও বাড়ানো যেত।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ধারাবাহিকভাবে কমতে শুরু করলেও দেশে গত শুক্রবার রাত ১২টা থেকে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিন তেল ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা করা হয়েছে (বৃদ্ধির হার ৪২.৫%)। একইভাবে অকটেনের দাম লিটারে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ৮৯ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা (৫১.৬৮%) এবং পেট্রল লিটারে ৪৪ টাকা বৃদ্ধি করে ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ করা হয়েছে (৫১.১৬%)। সার্বিকভাবে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম প্রায় ৫০ ভাগ বাড়ানো হয়েছে।
অথচ বিশ্ববাজারে আরো এক ধাপ কমেছে তেলের দাম। গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য ক্রমাগতভাবে কমছে। কারণ মন্দার আশঙ্কায় চাহিদায় প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে গত মাসে চীনের ক্রুড আমদানি ধীর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে নির্দেশ করে।
সোমবার সকালে দেখা যায়, প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ৭৪ সেন্ট বা শূন্য দশমিক আট শতাংশ কমে ৯৪ দশমিক ১৮ ডলারে নেমেছে, যা ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহের পর সর্বনিম্ন। তাছাড়া সাপ্তাহিকভিত্তিতে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ কমে ২০২০ সালের এপ্রিলের পর সর্বনিম্ন হয়েছে।
গত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের পর এবারই সবচেয়ে দ্রুত তেলের দাম কমছে। ধারণা করা হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে আবারো করোনার বিস্তার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তেলের চাহিদা হ্রাস পেতে শুরু করেছে।
এর আগে গত ৪ নভেম্বর ডিজেলের লিটার ৬৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়েছিল। এর প্রভাবে সে সময় দ্রব্যমূল্যসহ পরিবহন ভাড়া বেড়ে গিয়েছিল। এখন আবার দাম বাড়ানোর কারণে দ্রব্যমূল্য ও পরিবহন ভাড়া ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে বলে শঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে, যা এমনিতে ‘চিড়ে চ্যাপ্টা’ হওয়া সাধারণ মানুষের জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন।
এদিকে সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, বিপিসি গত ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের মে পর্যন্ত কোনো বছরই তেল বেচে লোকসান দেয়নি। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির নিট মুনাফা ছিল ৪৮ হাজার ১২২ কোটি ১১ লাখ টাকা। শুধু তাই নয়, চলতি অর্থবছরের মে ’২২ পর্যন্ত ১১ মাসে তেল বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি নিট মুনাফা করেছে এক হাজার ২৬৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
গত ৯ জুন অর্থ বিভাগ থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২২’ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে। সেখানে বিপিসির লাভ লোকসানের খতিয়ানও উপস্থাপন করা হয়েছে। সেখানে দেখানো হয়েছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে বিপিসি তেল বেচে মুনাফা করা শুরু করে।
সে বছর প্রতিষ্ঠানটির মুনাফার পরিমাণ ছিল চার হাজার ১২৬ কোটি আট লাখ। এর পরের অর্থবছর ২০১৫-২০১৬ মুনাফা করেছে ৯ হাজার ৪০ কোটি ৭ লাখ টাকা। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে মুনাফা আট হাজার ৬৫৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা। পরবর্তীতে একইভাবে মুনাফা করেছে ২০১৭-২০১৮ তে পাঁচ হাজার ৬৪৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। ২০১৮-২০১৯ তে চার হাজার ৭৬৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা। ২০১৯-২০২০ তে পাঁচ হাজার ৬৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ২০২০-২০২১ মুনাফা করেছে সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৫৫৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরের মে ’২২ পর্যন্ত বিপিসির মুনাফা এক হাজার ২৬৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
জানা গেছে, বিপিসি উন্নয়ন প্রকল্পের নামে কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করছে যাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে পদ্মা অয়েলের নামে ঢাকার শাহবাগে ৩৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ১২তলা ভবন নির্মাণ। এটি একটি আবাসিক ভবন হবে। একই সাথে চট্টগ্রামেও এ ধরনের বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পগুলো হাতে নেয়ার বিষয়ে এরই মধ্যে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।
উল্লেখ্য, দেশে প্রতি বছর জ্বালানি তেলের চাহিদা ৬৫ লাখ টন। এর আবার ৭৩ শতাংশ ডিজেল দ্বারা পূরণ করা হয়। ডিজেলের প্রায় পুরোটাই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। তবে অকটেনের চাহিদার অর্ধেকের বেশি এবং পেট্রলের পুরোটাই দেশে উৎপাদিত হয়।
তাই দেশে উৎপাদিত এই দুই পণ্যের দাম বাড়ানোকে অনেকে অযৌক্তিক এবং অন্যায় বলছেন। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রতি লিটার জ্বালানি তেলে সরকার ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ ভ্যাট ও ট্যাক্স নেয়। এই ক্রান্তিকালে সরকার যদি এই কর অর্ধেক কমিয়ে দিত তাহলে দাম না বাড়িয়েও সাম্প্রতিককালে যে লোকসান হচ্ছে তা সামাল দেয়া সম্ভব হতো।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫১৪
আপনার মতামত জানানঃ