তালিবানের ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন আফগানিস্তানে বসবাসরত শিয়া মতাবলম্বী সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের শঙ্কা ছিল, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ শাসনামলের মতো যদি তারা আবার জাতিগত নিগ্রহের শিকার হয়! তাদের আশঙ্কা যেনই বাস্তবে রূপ নিয়েছে। তালিবানরা ক্ষমতায় আসার পর থেকে জঙ্গিদের একের পর এক বোমা হামলায় জীবন নিয়ে আতঙ্কে শিয়ারা।
এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল শুক্রবার আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের একটি শিয়া আবাসিক এলাকায় একটি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ৮ জন নিহত হয়েছেন। ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গি গোষ্ঠী হামলার দায় স্বীকার করেছে।
পুলিশ বলছে, বিস্ফোরণে অন্তত আটজন নিহত ও ১৮ জন আহত হয়েছেন। জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস এক বিবৃতিতে বলেছে যে পশ্চিম কাবুলে হামলায় ২০ জন নিহত ও আহত হয়েছে।
পুলিশের মুখপাত্র খালিদ জাদরান বলেছেন, জনবহুল একটি এলাকায় বিস্ফোরণটি ঘটানো হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় বিস্ফোরণস্থলের কিছু ভিডিওতে দেখা গেছে, ঘটনার পর আহতদের সাহায্যে ছুটে আসে মানুষ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন তালিবান নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে একটি সবজির গাড়িতে বিস্ফোরক রাখা হয়েছিল। নারী ও শিশুসহ ৫০ জনেরও বেশি লোক হতাহত হয়েছে এ বিস্ফোরণে।
তিনি আরও বলেন, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ, আহতদের বেশিরভাগেরই আঘাত গুরুতর।
২০১৪ সাল থেকে আফগানিস্তানে সক্রিয় আইএসের অনুগত গোষ্ঠীটি। গত বছরের আগস্টে তালিবান দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর আইএসকে সবচেয়ে গুরুতর নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক হামলাগুলোর দায় স্বীকার করেছে আইএস। সংখ্যালঘু শিয়া সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে মূলত এসব হামলা চালানো হয়েছিল।
গত বছর তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে ধারাবাহিকভাবে আক্রমণের শিকার হচ্ছে শিয়া জনগোষ্ঠীর মানুষ। পাশাপাশি হাজারা, তাজিক, উজবেকসহ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপরও ক্রমাগত হামলার ঘটনা ঘটছে।
আফগানিস্তানের প্রতাপশালী পশতুন জনগণ হাজারাদের কখনো তাদের সমতুল্য মনে করতে পারেনি। হাজারারা শিয়া। পশতুনরা সুন্নি। ধর্মকেন্দ্রীক এ মতভেদ এবং হাজারাদের নিজস্ব জীবন ব্যবস্থার কারণে কখনো আফগানিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রে আসতে পারেনি সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়।
বেসামরিক সরকার হাজারাদের কথা শোনার চেষ্টা করলেও ১৯৯০-এর দশক থেকে জঙ্গিদের কিলিং মিশনের টার্গেটে পরিণত হয় হাজারারা। তালিবান থেকে শুরু করে যেকোনো সুন্নি উগ্রবাদীরা হাজারাদের মুসলমান মনে করে না।
তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে ধারাবাহিকভাবে আক্রমণের শিকার হচ্ছে শিয়া জনগোষ্ঠীর মানুষ। পাশাপাশি হাজারা, তাজিক, উজবেকসহ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপরও ক্রমাগত হামলার ঘটনা ঘটছে।
১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তালিবান কমান্ডার মাওলানা মোহাম্মদ হানিফ সমবেত সুন্নি জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘হাজারারা মুসলিম নয়, তাদের হত্যা কর।’ এরপর তাদের ওপর চরম নিপীড়ন চলতে থাকে। তালিবান সরকারের সময় হাজারাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
হত্যা-নির্যাতনের ভয়ে অনেক হাজারা শিয়াপ্রধান দেশ ইরানে পালিয়ে যায়। আর যারা মাটির মায়া ছাড়তে না পেরে থেকে যায়, তাদের ভাগ্যে জোটে নির্মম অত্যাচার।
১৯৯৮ সালে মাজার-ই শরিফে ষড়যন্ত্র করে কয়েক হাজার হাজারাকে হত্যা করা হয়। তালিবান ও আল-কায়েদার জঙ্গিরা সুযোগ পেলে হাজারাদের রক্তে হাত রাঙাতে দ্বিধা করে না।
বর্তমানে হাজারাদের নতুন শত্রু আইএস। পথে, বাসে, প্রতিষ্ঠানে যেখানে সুযোগ পাচ্ছে, সেখানে হামলা চালাচ্ছে তারা। চারদিক থেকে নির্যাতনের শিকার হাজারা সম্প্রদায়ের লোকজন প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তারা আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত জঙ্গিপ্রবণ আফগানিস্তানে হাজারারা নিষ্পেষিত— এ কথা প্রমাণ দিয়ে বলা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে এমন আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে যে, আফগানিস্তানে আসলে কারা সুরক্ষিত? কেউ নয়। জোর দিয়ে বলা যায়, যত দিন ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষ হত্যা বন্ধ না হবে, ততদিন শান্তি ফিরবে না আফগান মুল্লুকে। আর ততদিন শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না হাজারারা। ফলে শান্তির জন্য আফগানিস্তানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বহু বিভক্ত আফগানিস্তানে সেই সম্প্রীতি কবে হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪২
আপনার মতামত জানানঃ