বাংলাদেশের সরকার বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য গত এক দশকের বেশি সময় ধরে অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারপরেও এখনো বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ দেশের জিডিপির এক শতাংশেরও কম। কিন্তু কম?
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সর্বশেষ বিনিয়োগের পরিবেশ সংক্রান্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং সীমিত অর্থায়নের সুযোগের মত বেশ কিছু কারণ বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় বাধা সৃষ্টি করছে। যদিও বাংলাদেশের সরকার বলছে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা থাকলেও, সেসব সমস্যা সমাধানে সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
কী বলা হয়েছে রিপোর্টে?
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর দেশটির বিনিয়োগকারীদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগের পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা দিতে এ রিপোর্ট তৈরি করে। এতে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মোট ১২টি বাধাকে চিহ্নিত করা হয়েছে, এর মধ্যে বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে দুর্নীতিকে।
‘ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেট ২০২১’ নামের ওই বার্ষিক প্রতিবেদনে বিনিয়োগের প্রধান সমস্যা সম্পর্কে বলা হয়েছে, “বিনিয়োগের কিছু সীমাবদ্ধতা কমাতে বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে অগ্রগতি করেছে, কিন্তু অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, অর্থায়নের সীমিত সুযোগ, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা, শ্রম আইনের শিথিল প্রয়োগ এবং দুর্নীতি বিদেশী বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে।”
“দেশে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করার জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি প্রচেষ্টা সম্ভাবনা তৈরি করেছে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ায় ধীরগতি এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার ধীরগতির কারণে চুক্তির প্রয়োগ এবং ব্যবসায়িক বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যহত হচ্ছে।”
দুর্নীতি প্রতিরোধে বাংলাদেশের সরকার কয়েকটি আইন প্রণয়ন করলেও তার বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে। এছাড়া জমি সংক্রান্ত বিরোধকেও বিনিয়োগের বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, কৃষি, আইসিটি, অবকাঠামো ও প্রকৌশল সেবা, তৈরি পোশাক, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও সেবা, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাসহ মোট ৯টি খাতকে সম্ভাবনাময় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে রিপোর্টে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ৩টি খাতে উন্নতি করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে। এর মধ্যে রয়েছে, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করার চেষ্টা, এক দশক ধরে জিডিপি’র উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
ওই রিপোর্টে বিদ্যুৎ খাতে অগ্রগতির কথা বলা হলেও সম্প্রতি উৎপাদন এবং সরবারহে ঘাটতির কারণে দেশে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
সরকার কী বলছে?
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান মোঃ সিরাজুল ইসলাম বিবিসিকে বলেছেন, দুর্নীতি এবং আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতার সমস্যা নিয়ে কাজ করছে সরকার। তবে তিনি বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং দুর্নীতির যে কথা বলা হচ্ছে, আমি মনে করি না ঢালাওভাবে সেটি বলার সুযোগ আছে।
“দুর্নীতি নাই এটাও বলা যাবে না, আবার আছে ঢালাওভাবে সেটা বলারও সুযোগ নাই। কারণ হচ্ছে, যখন আপনি অনলাইনে সার্ভিস দিতে পারছেন, তখন কিন্তু দুর্নীতি করার সুযোগ অনেক কমে আসে।”
তিনি বলেছেন, এই মূহুর্তে নতুন বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় সেবার একটি বড় অংশকে সরকার ডিজিটালাইজড করেছে, এর ফলে আগ্রহী বিনিয়োগকারীরা নিবন্ধন-সহ অনেক প্রস্তুতি অনলাইনেই করতে পারেন।
তিনি বলেন, “ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে যখন বেশিরভাগ সেবা ডিজিটালাইজড করতে পারবো, তখন ডেফিনিটলি এই পরিবেশ পরিস্থিতি আরো অনেক বেশি উন্নতি হবে, আমি নিশ্চিত।”
তিনি আরও বলেছেন, বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিডার পাশাপাশি সরকারের একাধিক সংস্থা এবং মন্ত্রণালয় কাজ করে, দুর্নীতি কমানোর জন্য তারা সমন্বিতভাবে কাজ করছে।
সরকারের এসব চেষ্টার ফল হিসেবে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে বলে তিনি বলছেন। যদিও সেটি প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম সেটিও স্বীকার করেছেন তিনি।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগকারী একটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র, দেশটিতে এ পর্যন্ত মোট মার্কিন বিনিয়োগের পরিমাণ ৪১০ কোটি ডলার। বিডার তথ্য বলছে, মহামারির সময় দেশে বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেলেও সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরে সেটি বেড়েছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে যেখানে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ২৫৬ কোটি মার্কিন ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরের নয় মাসে তার পরিমান ২৬৫ কোটি মার্কিন ডলার।
কিন্তু বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে এক ধরণের নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তার ফলে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যেতে পারে এমন আশংকা করছে কর্তৃপক্ষ। সেজন্য আগেভাগে প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন বলে পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
এসডব্লিউ/এসএস/০৭৩২
আপনার মতামত জানানঃ