তাকে দেখলে মনে হতে পারে একজন দার্শনিক। আসলে ছিলেন একজন চিকিৎসক। তবে মূলত তিনি ছিলেন সিরিয়াল কিলার। আর তার শেষ পরিণতি হয়েছিল ভয়ংকর।
এই চিকিৎসকের নাম হ্যারল্ড শিপম্যান। ভালোবাসাহীন জীবন পেয়েছিলেন হ্যারল্ড। ১৯৪৬ সালের ১৫ জানুয়ারি নটিংহামের এক শ্রমজীবী পরিবারে জন্ম তার। হ্যারল্ডের বাবা ছিলেন একজন ট্রাক ড্রাইভার। কাজের জন্য গাড়ি নিয়ে তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়াতেন। ফলে বছরের অর্ধেক দিনই তিনি থাকতেন বাড়ির বাইরে।
পরিবারের প্রতি তার টানও কম ছিল। তাই ছেলেবেলা থেকেই শিপম্যান বাবার স্নেহ, মমতা থেকে প্রায় বঞ্চিত ছিলেন। সংসারে অভাবও ছিল নিত্যসঙ্গী। হ্যারল্ডের মা ছিলেন অসুস্থ। ছেলেবেলার দিনগুলোতে মায়ের অসুস্থতা, অর্থকষ্ট এবং হাজারও বঞ্চনা সবকিছুই শিপম্যানের সারা জীবনে ছায়া ফেলেছিল। এসব মানসিকভাবেও তাকে প্রতিনিয়ত গ্রাস করতো।
তবে শিপম্যানের প্রতিভা ছিল প্রখর। স্কুল জীবনে যুব রাগবী দলের সদস্য ছিলেন তিনি এবং স্কুল জীবনের শেষ বছরে তিনি স্কুলের অ্যাথলেট দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৭০ সালে লিডস্ থেকে ডাক্তারি পাস করেন হ্যারল্ড। কর্মজীবন তিনি ইয়র্কশায়ারে পোর্টফ্রেট জেনারেল ইনফরমারিতে কাজ শুরু করেন এবং ১৯৭৪ সালে পশ্চিম ইয়র্কশায়ারের আব্রাহাম অরমেরড মেডিক্যাল সেন্টারের জেনারেল প্রসিকিউটর (জিপি) হিসেবে প্রথম স্থান লাভ করেন।
নিজের ব্যবহারের জন্য প্যাথিড্রিন জোগাড় করতে প্রেসক্রিপশন জালিয়াতির কর্মকান্ডে ধরা পড়েন। বেশ মোটা জরিমানা এবং ড্রাগ রিহ্যাবিলিটেশন মাধ্যমে নিজেকে শুধরে আবার মূল পেশায় ফিরে আসেন হ্যারল্ড। হ্যারল্ড শিপম্যানের কাছে আগত রোগীদের মধ্যে মৃত্যুর হার ছিলো তুলনামূলক বেশি।
ডক্টর লিন্ডা ব্যাপারটি সাউথ ম্যাঞ্চেস্টার ডিস্ট্রিকটের করোনার জন পোলার্ডের কানে তোলেন এই বলে যে, বৃদ্ধাদের নামে বড্ড বেশি সংখ্যায় ক্রিমেশন ফর্ম তুলে সইসাবুদের জন্য পাঠানো হচ্ছিল তার কাছে। কিন্তু পুলিশের কাছে এর পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ ছিল না। ফলে শিপম্যানকে ধরতে পারছিল না পুলিশ। কেসটি প্রায় ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিলো সে সময়। তবে অনভিজ্ঞ পুলিশকর্মীদের হাতে এই কেসটির দায়িত্বভার ছেড়ে রাখার সিদ্ধান্তটিকে অনেকেই ভালো চোখে দেখেননি৷
পুলিশ ১৯৯৮ সালের ১৭ এপ্রিল অনুসন্ধান বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে শিপম্যান গ্রেফতার হওয়া আগ পর্যন্ত আরো তিন জনকে খুন করে খুনের তালিকা বড় করেন। তার শেষ শিকার ক্যাথলিন গ্রান্ডি৷
বয়সজনিত কারণেই গ্রান্ডির মৃত্যু হয়েছিল বলে গ্রান্ডির ডেথ সার্টিফিকেটে লিখে দিয়েছিলেন হ্যারল্ড শিপম্যান। গ্রান্ডির মেয়ে অ্যাঞ্জেলা উডরাফ সন্দেহ করেন যে তার মা নিজের সমস্ত সম্পত্তিই হ্যারল্ড শিপম্যানের নামে দান করে দিয়েছেন। সে সময়ের বাজারে এর অর্থমূল্য ছিলো তিন লাখ ছিয়াশি হাজার পাউন্ড। বিষয়টি অনেকের মনেই খটকা জায়গায়। খবর পেয়ে পুলিশও নড়েচড়ে উঠে।
শরীরের বেশি মাত্রায় ডায়ামর্ফিনের প্রয়োগ করে খুন করতেন হ্যারল্ড শিপম্যান। এর পর জাল মেডিকেল রিপোর্ট তৈরি করে বিভিন্ন ধরনের অসুখের কারণ দেখাতেন। এই সিরিয়াল কিলার একইভাবে গ্রান্ডির ডেথ সার্টিফিকেট লিখেছিলেন।
শিপম্যানের এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘প্রেসক্রিপশন ফর মার্ডার’ বইটি লিখেন ব্রায়ান হুটল্ এবং জাঁ রিচি। প্রথম তত্ত্বটি ছিল, টানা খুনখারাপির ফলে জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিলেন শিপম্যান। ক্রমশ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ইচ্ছে কমে এসেছিলো। দ্বিতীয় তত্ত্ব- পঞ্চান্ন বছর বয়সে সবকিছু আত্মসাৎ করে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ইংল্যান্ড ছেড়ে পালানোর মতলব এঁটে রেখেছিলেন তিনি৷
মোট পনেরোটি খুনের দায় চাপানো হয় তার ঘাড়ে। যদি মনে করা প্রায় আড়াইশোর অধিক লোক তার ভিক্টিম ছিল যাদেরকে তিনি হত্যা করেন। শিপম্যানের হাতে খুন হওয়া আশি শতাংশই নারী। ৫ অক্টোবর, ১৯৯৯ শিপম্যানের বিচার শুরু হয়।
২০০০ সালের ৩১ জানুয়ারি পনেরো জনকে হত্যা এবং ক্যাথলিন গ্রান্ডির উইল জাল করার দায়ে জুরি তাকে দোষী সাব্যস্ত করে। আদালত তাকে আজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। শিপম্যান ২০০৪ সালের ১৩ জানুয়ারি জেলখানায় আত্মহত্যা করেন। একটি চার বছর বয়সি মেয়ের খুনও শিপম্যানই করেছিলেন কি না সেই নিয়ে আজও সন্দেহ রয়ে গেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯১৪
আপনার মতামত জানানঃ