সারা পৃথিবীতেই দ্রুতগতিতে বাড়ছে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ। আর সেই কারণেই এটি নিয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। শনিবার ডব্লিউএইচওর তরফে ‘গ্লোবাল হেলথ ইমারজেনসি’ বা জনস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে এই রোগটি নিয়ে।
কিন্তু অর্থ কী? কোন কোন নীতি বদলাতে পারে এর ফলে? কী কী নিয়ম চালু হতে পারে? এর অর্থ হলো ডব্লিউএইচও এখন এই রোগটিকে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যের জন্য একটি বড়সড় বিপদ এবং উদ্বেগের কারণ হিসাবে দেখছে। এটি যাতে আরও ছড়িয়ে না পড়ে এবং মহামারির আকার না নেয়, সেজন্য সম্মিলিত আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ার বিষয়টিকেও এর পর থেকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।
যদিও এর ফলে কোনো দেশের উপর আলাদা করে নীতি আরোপ করার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ঘোষণার মাধ্যমে সব দেশকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে এবং আগামী দিনগুলিতে এই রোগটির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নীতি তৈরির বিষয়ে জোর দিচ্ছে। ডব্লিউএইচও তার সদস্য দেশগুলিকেও এই বিষয়ে নির্দেশ দিতে পারে। কিন্তু কিছু নীতি চাপিয়ে দিতে পারে না।
ইতিমধ্যেই চলতি বছরে ৭৫টি দেশে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। ১৬ হাজারেরও বেশি সংক্রমিত পাওয়া গিয়েছে এই রোগে। ডব্লিউএইচওর তথ্য অনুযায়ী, জুনের শেষ থেকে জুলাইয়ের শুরু পর্যন্ত সংক্রমণের সংখ্যা ৭৭ শতাংশ বেড়েছে। আফ্রিকায় এই বছরে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে মাঙ্কিপক্সের কারণে। যদিও আফ্রিকা মহাদেশের বাইরে এখনও পর্যন্ত এই রোগে মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।
ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের বক্তব্য অনুযায়ী, বেশিরভাগ আক্রান্ত দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে সেরে উঠছেন। অন্য পক্সের মতোই এই অসুখেও ত্বকে গোটা সৃষ্টি হয়। ব্রন বা ফোস্কার মতো ওই গোটাগুলির সংখ্যা বাড়তে থাকে। কারও কারও ক্ষেত্রে বিষয়টি খুব বেদনাদায়কও হয়।
যদিও এখনও পর্যন্ত এই রোগটি নিয়ে উদ্বেগের বিশেষ কারণ নেই। কিন্তু কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন, মাঙ্কিপক্স ঠিকমতো আটকাতে না পারলে, এর মিউটেশন হতেই থাকবে। তখন এটি মারাত্মক আকার নিতে পারে। এবং দৃষ্টিশক্তি চলে যাওয়ার মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে কারও কারও ক্ষেত্রে।
মাঙ্কিপক্স কী?
মাঙ্কিপক্স একটি বিরল ও স্বল্প পরিচিত রোগ। মাঙ্কিপক্স ভাইরাস এ রোগের জন্য দায়ী। বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার উষ্ণ ও আর্দ্র বনাঞ্চলের বানররা ছিল এ রোগের প্রথম শিকার। তারপর একসময় মানবদেহেও সংক্রমণ ঘটায় মাঙ্কিপক্স।
সাধারণত হালকা ভাইরাল সংক্রমণের জন্য দায়ী এই ভাইরাস। ভাইরাসটি গুটিবসন্তের মতো একই প্রজাতির সদস্য। এই প্রজাতির মধ্যে রয়েছে ভেরিওলা ভাইরাস; যা গুটিবসন্তের কারণ, ভ্যাক্সিনিয়া ভাইরাস (গুটিবসন্ত ভ্যাকসিনে ব্যবহৃত) ও কাউপক্স ভাইরাস।
কত প্রজাতির মাঙ্কিপক্স রয়েছে?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের দু’টি প্রজাতির সন্ধান মিলেছে।
১. কঙ্গো প্রজাতি
২. মধ্য আফ্রিকান প্রজাতি
মাঙ্কিপক্স কতটা প্রাণঘাতী?
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে কঙ্গো প্রজাতির প্রাদুর্ভাব অত্যন্ত গুরুতর। ওই অঞ্চলে কঙ্গো প্রজাতিতে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার ১০ শতাংশের বেশি। আর এতে বাচ্চাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি। অন্যদিকে, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতির তীব্রতা তুলনামূলক কম। এই প্রজাতিতে আক্রান্তদের মৃত্যুর হার ১ শতাংশের মতো।
এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১২টি দেশে শনাক্ত হওয়া মাঙ্কিপক্স আসলে কোন প্রজাতির তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। যদিও যুক্তরাজ্যে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতি শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।
মহামারি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ সাধারণত ‘একেবারে বিরল।’ যুক্তরাষ্ট্রের রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (সিডিসি) মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং সতর্ক করে বলেছে, পর্তুগাল ও স্পেনের প্রাদুর্ভাবের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যেও এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এরিক ফেইগল-ডিং বলেছেন, ‘এটা একেবারে অস্বাভাবিক। তারপরও লোকজন বলছে, এটা ঠিক ফ্লুর মতো, এছাড়া কিছু নয়। আমরা কি নতুন তথ্য-উপাত্ত দেখে শিক্ষা নিচ্ছি?’
মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হতে পারেন কীভাবে?
ভাইরাসটি মানবদেহে বেশ কয়েকটি উপায়ে প্রবেশ করতে পারে।
• ভগ্ন ত্বক (যদিও তা দেখা যায় না)
• শ্বাসতন্ত্র অথবা চোখ, নাক ও মুখ
• সংক্রমিত প্রাণীর কামড়
• আক্রান্ত প্রাণী অথবা মানুষের রক্ত, শরীরের তরল বা পশম স্পর্শ করা
• সংক্রমিত প্রাণীর মাংস সঠিকভাবে রান্না ছাড়া খাওয়া হলে
• ফুসকুড়ি রয়েছে এমন কারো ব্যবহৃত পোশাক, বিছানা অথবা তোয়ালে স্পর্শ করা
• মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত কারও ত্বকের ফোস্কা অথবা খোসপাঁচড়া স্পর্শ করা অথবা সংক্রমিত ব্যক্তির কাশি ও হাঁচির খুব কাছাকাছি যাওয়া
মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে বিশেষ ওষুধ বা ভ্যাকসিন আছে কি?
এখন পর্যন্ত মাঙ্কিপক্সের নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ অথবা ভ্যাকসিন নেই। অতীতে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ রোধে গুটিবসন্তের টিকা ব্যবহার করা হয়েছিল। ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের জন্য ব্যবহৃত টিকা মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে ৮৫ শতাংশ কার্যকর।
রোগীদের সেবা দেওয়ার সময় যারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন, সেই স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের গুটিবসন্তের টিকা দেওয়া শুরু করেছে যুক্তরাজ্য।
মার্কিন সিডিসি বলছে, গুটিবসন্তের অ্যান্টিভাইরাল ওষুধকে বিশেষ পরিস্থিতিতে মাঙ্কিপক্সের চিকিত্সায় ব্যবহার করা যেতে পারে।
মার্কিন সরকার বলেছে, পুরো দেশের মানুষকে টিকা দেওয়ার জন্য স্ট্র্যাটেজিক ন্যাশনাল স্টকপাইলে (এসএনএস) গুটিবসন্তের ভ্যাকসিনের যথেষ্ট মজুত আছে। এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগের একজন মুখপাত্র বলেছেন, গুটিবসন্তের জন্য অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ রয়েছে; যা বিশেষ পরিস্থিতিতে মাঙ্কিপক্সের চিকিত্সায় ব্যবহার করা যেতে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/০৭৩৩
আপনার মতামত জানানঃ