একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের তাড়িয়ে দিয়ে সম্পদ ও রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চাইছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের সাধারণ সম্পাদক ডা. এম. কে. রায়
শুক্রবার (২২) জুলাই জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট আয়োজিত ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক ও আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
ডা. এম. কে. রায় বলেছেন, ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ছোট বড় সাড়ে তিন হাজার মামলা হয়েছে। একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের তাড়িয়ে দিয়ে সম্পদ ও রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চাইছে। তাই যারা সাম্প্রদায়িক হামলা করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকে প্ররোচিত করছে।
বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি ড. শ্রীমতি সোনালী দাসের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের সাধারণ সম্পাদক ডা. এম. কে. রায়।
তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননার কথিত মিথ্যা অজুহাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বারবার ঘটে চলা সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দুদের ওপর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও লাঞ্ছনার ঘটনা ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণা বিদ্বেষেরই বহিঃপ্রকাশ। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, ভিন্নমত দমন, বহুত্ববাদী ও সহনশীলতা চর্চার অভাব দেশে একটি অসহিষ্ণু ও বিদ্বেষপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করছে। বিচারহীনতা ও ভয়ের সংস্কৃতির দরুন এই পরিস্থিতি এখন ভয়ঙ্কর ও অসহনীয় হয়ে উঠছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে কোনো ধর্মকে অবমাননা করার অধিকার যেমন কারও নেই, তেমনি আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে মন্দির, বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ভাঙচুর, খুন ও নির্যাতন করার অধিকার কাউকে দেওয়া হয়নি।
২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ছোট বড় সাড়ে তিন হাজার মামলা হয়েছে। একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের তাড়িয়ে দিয়ে সম্পদ ও রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চাইছে। তাই যারা সাম্প্রদায়িক হামলা করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকে প্ররোচিত করছে।
বাংলাদেশের মতো একটি অসাম্প্রদায়িক দেশে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা সাম্প্রদায়িক হামলার সঙ্গে জড়িত ও মদদদাতা তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় হামলা বেড়েই চলেছে। এর দায় সরকারকে নিতে হবে।
এম. কে. রায় বলেন, কক্সবাজারের রামু থেকে নড়াইলের সাম্প্রদায়িক হামলা পর্যন্ত একটি ঘটনারও সুষ্ঠু বিচার আমরা পাইনি। সারা দেশে সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষকরা আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। প্রতিটি ঘটনা পুলিশ ও প্রশাসনের সামনেই ঘটছে।
এদিকে দেশে সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনায় চলতি বছর এখন (৩০ জুন) পর্যন্ত সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ৭৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ১৩ জন ধর্ষণ, ১০ জন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, ধর্ষণের পর তিন জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে সম্প্রতি দাবি করেছে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট।
সংগঠনটির মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিকের দাবি, এই সময়ে আরও ৬২০ জনকে হত্যার হুমকি, ১৪৫ জনকে হত্যার চেষ্টা, ১৮৩ জনকে জখম-আহত ও ৩২ জন নিখোঁজ হয়েছেন।
গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিকের দাবি, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৪৬৮টি বসতবাড়ি হামলা ভাঙচুর ও লুটপাট, ৩৪৩টি অগ্নিসংযোগ, ৯৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ২ হাজার ১৫৯ একর ৩৬ শতাংশ ভূমি দখল এবং ৪১৯ একর ৬৩ শতাংশ দখলের তৎপরতা চালানো হয়েছে। ঘরবাড়ি দখল হয়েছে ১৭টি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ২৯টি, মন্দিরের জমি দখল ২৯টি, বসতবাড়ি উচ্ছেদ হয়েছে ১৩২টি। এ ছাড়া ৭১৭টি পরিবারকে উচ্ছেদের চেষ্টা, ৮ হাজার ৯৪৩টি পরিবারকে উচ্ছেদের হুমকি, ১৫৪টি পরিবারকে দেশত্যাগের বাধ্যকরণ, ৩ হাজার ৮৯৭টি পরিবারকে দেশত্যাগে হুমকির শিকার এবং ১ লাখ ১৫ হাজার ৪২৯টি পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে।
তিনি আরও দাবি করেন, চলতি বছরে ৫০১টি সংঘবদ্ধ হামলা, ৫৬টি মন্দিরে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগ, ২১৯টি প্রতিমা ভাংচুর, ৫০টি প্রতিমা চুরি, ৭৭ জনকে অপহরণ, ১৫ জনকে অপহরণের চেষ্টা করা হয়েছে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৩ জন ধর্ষণ, ১০ জন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, ধর্ষণের পর তিন জনকে হত্যা, ১৯ জনকে ধর্ষণচেষ্টা, ৯৫ জনকে ধর্মান্তরিত করা, ২১ জনকে ধর্মান্তরের চেষ্টা, ৬৩টি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ঘটনাও ঘটেছে দেশে।
এ ছাড়াও মিথ্যা মামলায় সম্প্রদায়টির ৯৬ জনকে গ্রেপ্তার, বরখাস্ত, চাকরিচ্যুত ও জেল-জরিমানা, ৮০২টি পরিবারকে অবরুদ্ধ করা, ৫৭টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান অপবিত্রকরণ, ৬০টি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে বাধা, ১০০ জনকে ধর্মীয় নিষিদ্ধ গরুর মাংস খাওয়ানোর ঘটনা ঘটেছে। মোট ৬৩৮টি আলাদা ঘটনা ঘটনায় ক্ষতি হয়েছে ১৫২ কোটি ৩৫ লাখ ৫৫ হাজার টাকার।
গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক বলেন, ‘এসব ঘটনার ধারাবাহিকতায় প্রমাণিত হয় যে, এদেশে হিন্দুদের বসবাস দিনকে দিন কঠিনতর হচ্ছে।’
সারা দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মদদেই হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকারই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে। বিএনপি-জামায়াতের ওপর এসবের দায় চাপিয়ে তারা আবারও ক্ষমতায় আসতে চায়।
আওয়ামী লীগ সরকারের কারণে মানুষের মননে সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এই সরকারের শাসনামলেই পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ, কওমি জননী উপাধি দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগের তৈরি করা জমিতেই এখন সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের চাষ হচ্ছে।
তারা বলেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীদের উসকানি দিতে দেখা গেছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই বেড়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তির পাহারাদার। এদের দিয়ে প্রগতিশীলতা রক্ষা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া যাবে না। সারা দেশে অব্যাহত সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধ করা, এর সঙ্গে জড়িত ও মদদদাতাদের গ্রেপ্তার-বিচার করা এবং হামলা-লুটপাটের দায় সরকার ও পুলিশ-প্রশাসনকে নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫৫
আপনার মতামত জানানঃ