আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে ডলারের দর বাড়ছেই আর দরপতন হচ্ছে বিভিন্ন দেশের স্থানীয় মুদ্রার। এমন এক পরিস্থিতিতে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ভারতীয় মুদ্রা রুপিকে নতুন গুরুত্বে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ভারতের শীর্ষ ব্যাংক ঘোষণা করেছে, রুপির মাধ্যমেই যাতে আন্তর্জাতিক লেনদেন করা যায়, তেমন ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। অর্থাৎ চীন ও রাশিয়ার পর ভারতও ডলারকে পাশ কাটানোর নীতিতে যাচ্ছে। যা ডলার কেন্দ্রিক অর্থনীতির জন্য বড়সড় একটা হুমকি।
আর এ অবস্থাতেই বাংলাদেশের সঙ্গে আবারও রুপিতেই বাণিজ্য করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে ভারত। আর এই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন বিশ্ব অর্থনীতিতে বেশ জোরেশোরেই আঘাত জানবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে ডলারের দর বাড়ছে আর দরপতন হচ্ছে বিভিন্ন দেশের স্থানীয় মুদ্রার। ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের নতুন উদ্যোগের ফলে বর্তমান ব্যবস্থার পাশাপাশি ইনভয়েসিং, পেমেন্ট এবং আমদানি বা রপ্তানির সেটেলমেন্ট ভারতীয় মুদ্রার মাধ্যমে করা যাবে।
এদিকে, বাংলাদেশের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য করার আগ্রহ এই প্রথম দেখায়নি ভারত। এর আগে ২০১৩ সালেও এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল ভারত। তখনো ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির ক্রমাগত মান পড়ছিল। ২০১৩ সালের ৬ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির রেকর্ড দরপতন হয়। সেদিন প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৬১.৮০ রুপিতে উঠে। তখন পর্যন্ত এটি ছিল ডলারের বিপরীতে রুপির সর্বনিম্ন দর। তবে ২০২২ সালে ইউক্রেন আগ্রাসনে স্থানীয় মুদ্রার পতনের মুহূর্তে বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিটাও বেশ জটিল এবং নাজুক।
এক্ষেত্রে তাই ভারতের সাথে রুপিতে বাণিজ্যে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক দিকের পাশাপাশি রাজনীতি নিয়েও ভাবতে হবে। ভারতের ডলারকে পাশ কাটানোর এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে নেবে, সেটা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গত, মার্কিন ও আন্তর্জাতিক অবরোধের মুখে পড়ে ইরান খাদ্য ও ওষুধের বিপরীতে জ্বালানি তেল রপ্তানিতে ভারতের সঙ্গে রুপি সোয়াপ করেছে। আর অর্থনৈতিক লাভক্ষতির সমীকরণ তো আছেই।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে আঘাত
শুরুতে ‘কারেন্সি সোয়াপ অ্যারেঞ্জমেন্ট’ সম্পর্কে জানা যাক। ডলার বা অন্য কোনো হার্ড কারেন্সিকে এড়িয়ে দুটি দেশ যখন নিজেদের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য চালায়, সেটিকে আর্থিক পরিভাষায় ‘কারেন্সি সোয়াপ অ্যারেঞ্জমেন্ট’ বলা হয়।
একটি দেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে সরাসরি ‘কারেন্সি সোয়াপ অ্যারেঞ্জমেন্ট’, অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে ‘ভারতীয় রুপি সোয়াপ’ চুক্তি খারাপ কিছু নয়। ডলারের দাম ওঠা-পড়ার জন্য বর্তমানে দুই দেশের ব্যবসায়ীদেরই ভুগতে হচ্ছে। ফলে লেনদেন সরাসরি রুপিতে হলে তাতে দুই পক্ষই উপকৃত হতে পারে।
বড় অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিগুলোর ডলারকে পাশ কাটিয়ে এমনটি করার উদাহরণ দু-একবার দেখা গেলেও ছোট দেশের জন্য মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে এটা করে দেখানোটা বেশ কঠিন।
এমন উদ্যোগকে, যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থে আঘাত হিসেবে দেখবে কি না, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভারতের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি বছরভেদে ১২ থেকে ১৩ গুণ বেশি। ফলে ডলার বাঁচাতে গিয়ে বাংলাদেশ যাতে প্রধানতম রপ্তানি বাজার বিকাশের পথে ‘নতুন বাধা’ কিংবা ‘খারাপ’ কিছু ডেকে না আনে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ যা আমদানি করে, তার ১৮ থেকে ২০ গুণ বেশি রপ্তানি করে। আয় করা ডলার ওই বাজারে খরচ হয়ে যায় না। আনুমানিক ৭০০ মিলিয়ন ডলারের আমদানির বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রে বছরভেদে ১৪ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি বাংলাদেশের। এর সুরক্ষা জরুরি।
যে সমস্যায় পড়তে হবে বাংলাদেশকে
ভারতের ক্ষেত্রে আমদানি-রপ্তানির হিসাবটা যুক্তরাষ্ট্রের পুরো উল্টো। বাংলাদেশ ভারতের বাজারে যা রপ্তানি করে, তার পাঁচ থেকে ছয় গুণ বেশি আমদানি করে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ডলার আয়ের উৎস হলেও ভারতের বাজার আমাদের ডলার খরচের জায়গা।
বাড়তি ‘রুপি’ আয়ের কোনো উৎস নেই বাংলাদেশের; বরং ডলারেই আমদানি বাণিজ্য হয়। এক বা সোয়া বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির বিপরীতে ভারত থেকে সাত-আট বিলিয়ন ডলারের আমদানি করে বাংলাদেশ। ফলে প্রশ্ন হচ্ছে বাণিজ্যবৈষম্যের অন্তত ছয় বিলিয়ন ডলারের বিপরীতে রুপির উৎস কী?
বাংলাদেশ কি প্রবাসী আয় থেকে অর্জিত ডলারকে রুপিতে পরিবর্তন করে তারপর রুপিতে আমদানি করবে? যে ডলার সংরক্ষণের জন্যই ‘মুদ্রা বিনিময়ের’ প্রস্তাব, সেই রিজার্ভ মুদ্রা খরচ হয়ে গেলে আমাদের কী লাভ?
বাড়তি ‘রুপি’ আয়ের কোনো উৎস নেই বাংলাদেশের; বরং ডলারেই আমদানি বাণিজ্য হয়। এক বা সোয়া বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির বিপরীতে ভারত থেকে সাত-আট বিলিয়ন ডলারের আমদানি করে বাংলাদেশ। ফলে প্রশ্ন হচ্ছে বাণিজ্যবৈষম্যের অন্তত ছয় বিলিয়ন ডলারের বিপরীতে রুপির উৎস কী?
অন্য উপায় হতে পারে, ভারতের ব্যাংক থেকে রুপিতে ঋণ করে সেটি দিয়ে ভারতীয় পণ্য কেনা। এটা সুদের দায় বাড়াবে। তদুপরি সুদের শর্তটা গুরুত্বপূর্ণ। অভিযোগ আছে, প্রতিবেশীর বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্নে ভারত রাষ্ট্র হিসেবে বেশ অনুদার।
উপরন্তু বাংলাদেশের শ্রমবাজারে কাজ করে কয়েক লাখ ভারতীয় শ্রমিক রেমিট্যান্স নিয়ে যান। বাংলাদেশিরাও চিকিৎসা, ভ্রমণ, শপিংসহ অন্যান্য উদ্দেশ্যে ডলার নিয়ে ভারতে যায়। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের উপার্জিত ডলারের একটি বড় অংশ বৈধ কিংবা অবৈধভাবে ভারতে চলে যায়। তাহলে রুপি আয়ের বৈধ উপায় কী?
ঝুঁকিপূর্ণ কেন?
ভারত করোনার আগে-পরে রুপির দরপতন ঘটিয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশ টাকার মান ধরে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। অর্থাৎ সঠিক মূল্যায়িত রুপির বিপরীতে অতি মূল্যায়িত টাকার প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। পতনশীল রুপিতে বাণিজ্য করলে বাংলাদেশের লোকসান বেশি হবে কারণ, এখনো বাংলাদেশ টাকাকে শক্তিশালী রাখতে বদ্ধপরিকর।
উল্লেখ্য যে ২০১৬ সালে ভারত ৫০০ ও ১০০ রুপির নোট বাতিল করলে বাংলাদেশ ব্যাংকে কিংবা বাংলাদেশের মানি এক্সচেঞ্জের পুরোনো রুপির বিনিময়ে নতুন নোট ইস্যু করেনি বলে অভিযোগ আছে।
ডলারকে পাশ কাটিয়ে ভারতীয় রুপিতে বাণিজ্য করার লক্ষ্য হচ্ছে রুগ্ন রুপিকে শক্তিশালী করা। ভারতের সঙ্গে যেহেতু বাংলাদেশের বাণিজ্যবৈষম্য ব্যাপক, স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে যে এত রুপি আমরা কোথায় পাব? উল্টো যখন রুপির বিপরীতে টাকার দরপতন হবে, তখন দফায় দফায় বাড়বে আমদানি ব্যয় ও মূল্যস্ফীতি।
যেহেতু বাংলাদেশ খাদ্যপণ্য ও কাঁচামাল ভারত থেকে একচেটিয়া আমদানি করে, তাই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রুপির বিপরীতে টাকার দরপতন একটি ভয়াবহ বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিতে পারে।
ডলার ও ইউরো মুদ্রা দুটি এত ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হওয়ার একটি কারণ সহজলভ্যতা, অন্যটি তার সুইফট-সংযোগ। ভারতীয় মুদ্রার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সুইফট-সংযোগ কিংবা ভিসা, মাস্টারকার্ড পেপালসহ যাবতীয় আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ে-সংযোগের আয়োজন সীমিত বলে পেমেন্ট গেটওয়ে-সংযোগের দিক থেকেও সরাসরি ‘কারেন্সি সোয়াপ’ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৪০
আপনার মতামত জানানঃ