বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের জন্ম হয়েছিলো শেফালির। দেশভাগের পর তার বাবা-মা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতের কলকাতায় চলে যান। শেফালি তথা আরতি দাস তখন খুবই ছোট। কলকাতার আহিরীটোলার এক বস্তিতে, আরও অনেক উদ্বাস্তু শিশুর মতো সে-ও বেড়ে উঠেছিলো। ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর ব্যাধির সঙ্গে লড়াই ছিলো তার আজন্মের।
অসুস্থ বাবার নিয়মিত কোনও রোজগার ছিল না। মা মানুষের বাসায় ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালাতেন। ঠিক এইরকম একটি অবস্থান থেকে কী করে একটি মেয়ে, কতো রক্ত আর ঘাম ঝরিয়ে, কতো একাগ্রতা ও নিবিড় সাধনায় একদিন হয়ে উঠেছিলেন এক দক্ষ ক্যাবারে ড্যান্সার।
ডান্সার হিসেবে আকাশছোঁয়া খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। রাতের হলরুমের মোহনীয় আলোয়, মিউজিকের তালে-তালে নেচে সে সমবেত দর্শককে মাতিয়ে উপার্জন করতেন শেফালি। সে টাকায় চলতো সংসার।
তবে শেফালির নাচকে শুধুমাত্র জীবন ধারণের উপায় বললে ভুল হবে। এ ছিলো শিল্প। মিস শেফালির নাচ দেখার জন্য লাইন ধরে অপেক্ষা করতেন তখনকার কলকাতার অভিজাত শ্রেণির নারী-পুরুষেরা। আবার অনেক নামীদামী শিল্পী যেমন সৌমিত্র চট্ট্যোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, সাবিত্রী চট্ট্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন তাচ্ছিল্য ও অসম্মান।
এই লাস্যময়ী জীবনভর প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছিলেন বহু মানুষের কাছ থেকে। কিন্তু ভালবেসেছিলেন একজনকেই। সেই প্রেমিকের নাম ছিল রবিন রুটল্যান্ড। মা খ্রীষ্টান, আইরিশ। বাবা ছিলেন মুসলিম, লখনৌর এক অভিজাত ব্যবসায়ী পরিবাবের সন্তান, যিনি সপরিবারে চলে গয়েছিলেন অ্যামেরিকায়। অল্পবয়সেই মারা গিয়েছিলেন তিনি।
পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক সম্পত্তির ব্যবস্থা করার জন্য মুম্বাই এসেছিলেন রবিন রুটল্যান্ড। উঠেছিলেন রিৎজ কন্টিনেন্টাল হোটেলে। এই হোটেলের আইরিশ ম্যানেজার ছিলেন মায়ের দিক থেকে রবিন রুটল্যান্ডের আত্মীয়। সেইসময়, অভিজাত এই হেটেলের পার্টিগুলোতে ওরিয়েন্টাল নাচ করার জন্য কলকাতা থেকে তিন মাসের কন্টাক্টে গিয়েছিলেন মিস শেফালি। মিস শেফালির নাম তখন সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে।
এই হোটেলেই রবিন রুটল্যান্ডের সঙ্গে পরিচয় হয় মিস শেফালির। হোটেল ম্যনেজারের অনুরোধে, পার্টীগুলোতে নাচ শুরু হওয়ার আগে অতিথিদের সামনে গিটার বাজিয়ে গান গাইতেন রুটল্যান্ড। চমৎকার ছিল গানের গলা। অভিজাত, মার্জিত রুচির এই সুদর্শন যুবকের প্রেমে পড়েন মিস শেফালি। কিছুদিনের মধ্যেই এক গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে দুজনের মধ্যে।
রুটল্যান্ড চলে যাওয়ার আগে, মিস শেফালিকে বিয়ে করে আমেরিকা নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু মিস শেফালি তাতে সাড়া দেননি। জীবনের এই পর্যায়ে এসে এক বিরাট টানাপোড়েনে পড়েছিলেন তিনি। বারো বছর বয়সে ঘর ছাড়া আরতি দাস যে নিজের চেষ্টায় একটু একটু করে নিজেকে সম্রাজ্ঞীর আসনে বসিয়েছিলেন, সেই আসন ছেড়ে সংসারের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার সন্ধিক্ষণে তার শিল্পীসত্তা ভেতর থেকে বলে ওঠেছিল “না”।
পরিণামে আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ না-হলেও দুজনকেই দুজনের পথ বেছে নিতে হয়েছিল। রবিন রুটল্যান্ড ফিরে গিয়েছিলেন অ্যামেরিকায়। মিস শেফালি তার পেশা নিয়ে থেকে যান কলকাতায়। কিন্তু অ্যামেরিকা চলে যাওয়ার পরেও, অনেক বছর মিস শেফালির অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। মাসের পর মাস শেফালিকে চিঠি লিখে তার কাছে চলে যাওয়ার অনুরোধও করেছিলেন। প্রতিবার প্রেমিকের চিঠি পড়ে কেঁদেছেন, কিন্তু তার ডাকে সাড়া দিয়ে আমেরিকা পাড়ি দিতে পারেননি মিস শেফালি।
পারেননি কারণ তিনি তার পেশাকে আরও বেশি ভালোবেসেছিলেন। সেজন্য আত্মজীবনীতে বয়ান দিয়েছেন এভাবে- যখন ড্রাম বিটের সঙ্গে নিখুঁত তাল রেখে আমি ঢুকতাম ফিরপোজের লিডো (নাচের রুম) কিংবা ওবেরয় গ্র্যান্ডের প্রিন্সেসে (নাচের রুম)। বাঁ পা-টা একটু এগিয়ে, বুড়ো আঙুল দিয়ে … ড্যান্স ফ্লোরটা সামান্য ছুঁয়ে, দুটো হাত তুলে অডিয়েন্সের সামনে দাঁড়াতাম, পিনড্রপ সায়লেন্ট হয়ে যেত হলঘর। দম বন্ধ করে শুধু আমাকেই দেখছে ওইটা ছিল আমার মুহূর্ত। রাতের কলকাতার হুল্লোরকে এক লহমায় থামিয়ে দিতে পারতাম আমি।’
এমন আত্মতৃপ্তি শিল্পীর কাছে পরম আরাধ্য। কিন্তু মিস শেফালির জীবনের শেষ কয়েকটা বছর কেটেছে নিদারুণ আর্থিক অনটন ও নিঃসঙ্গতায়। রবিন রুটল্যান্ডের কথায় যেন সত্য হয়েছিলো- এমন একটা সময় আসবে আরু (আরতি), যখন তুমি একা হয়ে যাবে। তোমার নাচ তোমার সঙ্গে থাকবে না, কেরিয়ার থাকবে না। তখন আমার কথা মনে পড়বে। তখন হয়তো তোমার মনে হবে, ভুল হয়েছিল।
তাই হয়েছিল আরতির জীবনে। জীবনের শেষ সময়ে জ্বরা ও ব্যাধি তাকে পর্যুদস্ত করে ফেলেছিল। ২০২০ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি, লোকচক্ষুর আড়ালেই মারা যান তিনি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯১৫
আপনার মতামত জানানঃ