ঢাকাই মসলিন এমন এক শাড়ি যা মেশিনে বানানো সম্ভব নয়। সূত্র মতে, মসলিনের নমুনা পৌঁছেছে ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেস্টারেও। সেখানে চলেছে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তারপর বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ শাড়ি মেশিনে বোনা সম্ভব নয়।
কথিত আছে সম্রাট জাহাঙ্গীর যখন নূরজাহানের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বারবার প্রত্যাখ্যাত হচ্ছিলেন। এরপর নাকি ঢাকাই মসলিন উপহার দিয়েই সম্মতি আদায় করেছিলেন।
কার্পাস তুলার সুতা থেকে তৈরি এই মসলিন এ রকম মিহি যে একটি আংটির ভেতর দিয়েও এপার ওপার করা যায়। আবার এ শাড়ি ভাঁজ করে রাখা যায় দিয়াশলাইয়ের বাকশেও। অথচ হারিয়ে গিয়েছিলো এই শাড়ি। তার পেছনে রয়েছে বাজার ও রাজনীতির প্রভাব।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের মদন তাঁতির কথা মনে আছে, মহাজন ঋণ দিতে চায় শাড়ি বুনতে নয়, গামছা করতে। কারণ, বাজারে গামছার চাহিদা ছিল, শাড়ির চাহিদা ছিল না। বিদেশি কাপড়ে মজেছিল বাঙালিরাও।
১৮৩৭-এ রানি ভিক্টোরিয়ার সময় ইংল্যান্ড প্রাচুর্যের চূড়ায়। শিল্প বিপ্লবের ফলে সমৃদ্ধ হয়েছিলো তাদের অর্থনীতি। ঐ সময় ম্যাঞ্চেস্টারের বস্ত্র শিল্পেরও বিপ্লব ঘটে। এই বস্ত্র পৌঁছে গিয়েছিলো পুরো বিশ্বে। সে সময় রেহাই পায়নি বাংলার বাজারও। এতে কোণঠাসা হয়ে পড়ে ঢাকাই মসলিন। যন্ত্রে বোনা বস্ত্রের কাছে হার মানে হাতে বোনা বস্ত্র।
তাঁতিদের অসামান্য মনোযোগে মসৃণ, মনোরমভাবে তৈরি হত মসলিন। মাকড়সার জাল, বাবুই পাখির বাসার শিল্পকলা ফুটে উঠতো মসলিন শাড়িতে। এছাড়া গাছের পাতা ফুল, ফল যেমন আপনা-আপনিই হয়, এও তেমনি প্রকৃতির আশ্চর্য নির্মাণ। অরণ্যে খোঁজ করলে পাওয়া যাবে। বনের কীটপতঙ্গ পাখির মোটিফ করা হতো মসলিনের জমিন জুড়ে।
সে সময়ের বাজারে এই শাড়ির দামও ছিল একটু বেশি। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বিদেশি স্বল্পমূল্যের কাপড়ের চাহিদা বেড়ে গেল। তাঁতে বোনা কাপড় কে কিনবে?
পাশাপাশি ব্রিটিশ শাসনে থাকা বাংলার তাঁতিরা বঞ্চিত হলো সরকারি প্রণোদনা থেকে। বাজার প্রতিযোগিতায় তারা সরে দাঁড়ালো পেছনের সারিতে। তাঁতিদের জন্য বরাদ্দ যেন শুধুই অন্ধকার।
১৯৪৭-এ দেশ ভাগের পর কৃত্রিম সুতায় তৈরি বস্ত্র বাজার ছেয়ে যায়। তার মধ্যেও তাঁতের শাড়ি কোনও রকমে বেঁচে থাকে। নতুন করে যাত্রা শুরু করে ঢাকাই জামদানি। তবে বাজারে মসলিনের আর দেখা পাওয়া গেল না। মসলিন থাকলো শুধু জাদুঘরে। মসলিন শাড়ি বুনতে দরকার ছিল ৩০০ কাউন্টের মিহি সুতা। যে সুতার ৫০০ মিটারের ওজন মাত্র এক গ্রাম।
মসলিন শাড়ি বোনা হতো ফুটি কার্পাসে। এ চাষ হত ঢাকা শহর থেকে একটু দূরে মেঘনা আর শীতলক্ষার তীরে। কার্পাস থেকে সুতা তাঁতিদের ঘরে উঠলে কেচে নিয়ে শুকিয়ে নিতো তাঁতিরা। এরপর শাড়ির বোনার পালা। আঙুলের নিপুর ব্যবহারে পুরো মাস লাগিয়ে একজন তাঁতি একটি শাড়িকে শিল্পের সমতুল্য তৈরি করে ফেলতেন।
এই শিল্প, বাংলার ঘরে আবার ফিরে আসছে ১০৭বছর পর। কারণ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে কার্পাস চাষে ১২৪০ কোটি ৩৮ লক্ষ টাকার প্রকল্প শুরু হয়েছে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে বাংলাদেশের একদল গবেষক দীর্ঘ ছয় বছর গবেষণা করে সক্ষম হয়েছেন ঢাকাই মসলিন তৈরিতে।
তাঁত শিল্পীদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা হচ্ছে। প্রবীণরা নবীনদের শেখাবেন এই শিল্প বয়ন। তাদের হাত ধরেই ফিরবে ঢাকাই মসলিন। বিশ্বে বাংলাদেশের মান বাড়বে। দুনিয়া বুঝবে, বাঙালি তার গৌরব হারালেও ফিরিয়ে আনে।
প্রাথমিক পর্যায়ে গবেষকরা ছয়টি মসলিন শাড়ি তৈরি করেছেন। যার একটি ইতোমধ্যে প্রধামন্ত্রীকে উপহার দিয়েছেন তারা। এই কাপড়গুলো ঠিক সেরকমই, আংটির ভেতর দিয়ে অনায়াসে পার করে দেওয়া গেছে আস্ত একটি শাড়ি! একটি মসলিন শাড়ি তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। প্রাথমিক পর্যায়ে সময় লেগেছে ছয় মাস।
সময়ের সঙ্গে জনশক্তি বাড়ানো হলেও এর খরচ তিন লাখের নিচে নামবে না বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। সেক্ষেত্রে এর বাজারমূল্য হবে কমপক্ষে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা। ওয়ার্ল্ড ব্রান্ড ঢাকাই মসলিন বিশ্বে তার দাপট দেখাবে বাংলার হয়ে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮০৫
আপনার মতামত জানানঃ