আফগানিস্তানে নারীদের সমাজ থেকে অদৃশ্য করে ফেলা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ইউএনএইচআরসি।
শুক্রবার (৮ জুলাই) এক প্রস্তাবে সংস্থাটি আফগান নারীদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে তালিবান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে৷
গত বছরের আগস্ট মাসে দ্বিতীয়বারের মতো আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করে তালিবান৷ এরপর থেকে সেখানকার নারীদের পোশাক, চলাফেরা ও শিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তারা।
ইউএনএইচআরসির প্রস্তাবনার বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি হিসেবে চেক রাষ্ট্রদূত ভাস্লাভ বালেক বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘‘২০২১ সালে আগস্ট মাস থেকে আফগানিস্তানের মানবাধিকার পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে, বিশেষ করে নারীদের জন্য। তালিবান এতটাই কড়াকড়ি আরোপ করেছে যে তারা আফগান সমাজ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে।”
২০২১ সালে আগস্ট মাস থেকে আফগানিস্তানের মানবাধিকার পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে, বিশেষ করে নারীদের জন্য। তালিবান এতটাই কড়াকড়ি আরোপ করেছে যে তারা আফগান সমাজ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার সিদ্ধান্তের কারণে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতায় পড়বে না তালিবান৷ তবে এর রাজনৈতিক প্রভাব আছে৷ এমনকি এই সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিক তদন্তের সুযোগও তৈরি করতে পারে৷ অনেকগুলো দেশের সম্মতি থাকায় শুক্রবারের সিদ্ধান্তটি কোনো ভোট ছাড়াই পাস হয়েছে৷
তবে চীন এই সিদ্ধান্তকে “ভারসাম্যপূর্ণ নয়” বলে মন্তব্য করে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের সমর্থনকারী, আফগানিস্তানের সাবেক দূত মহিবুল্লাহ তাইব বলেন, তালিবানের নিষেধাজ্ঞাগুলো “নারীবিদ্বেষপ্রসূত”৷
আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে আফগান নারী অধিকারকর্মীদের নিয়ে এ বিষয়ে একটি আলোচনা হবে৷
নারীদের জন্য পৃথিবীতে নরক হয়ে উঠেছে আফগানিস্তান। হত্যা, নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, ধর্ষণ, চাকরির সুযোগ হারানোর পর এবার বিক্রি করা হচ্ছে দাস হিসেবে। ১৯৯৬ সাল থেকেই আফগানিস্তানের নারীদের পথচলা অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বেশি বন্ধুর। এক পা এগোলে দশ পা পিছিয়ে যেতে হয় তাদের। দেশের শাসনব্যবস্থা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় আফগান নারীর জীবনযাত্রা। চলার পথের প্রতিবন্ধকতাও বেড়ে যায়।
গত আগস্টে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়া তালিবান দাবি করেছিল, তারা পাল্টেছে অনেকটায়। নব্বইয়ের দশকের কট্টর অবস্থান থেকে বেশ উদার হবে এবার।
তবে গোটা আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ পোক্ত করার পর নারীদের নব্বইয়ের দশকের সেই শাসনের মতোই ঘরবন্দি করে ফেলেছে তারা।
তালিবানের সবশেষ শাসনামলে (১৯৯৬ থেকে ২০০১) নারীরা কাজ করতে পারত না। মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। নারীরা বাড়ির বাইরে বের হলে চেহারা ঢেকে ও পুরুষ সঙ্গীকে নিয়ে বের হতে হতো।
যারা এই আইন অমান্য করতেন ইসলামি শরিয়া আইনের কট্টর ব্যাখ্যার অধীনে তাদের জনসমক্ষে পেটাত তালিবানের ধর্মীয় পুলিশ।
রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যর্থ আলোচনা চালানো তালিবান পশ্চিমাদের কথা দেয়, নারীরাও ‘ইসলামী আইন’ অনুযায়ী কাজ করা ও শিক্ষা গ্রহণের সমান অধিকার পাবেন।
২০ বছর পর গত ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান দখলে নেয় তালিবান। এরপর সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে তালিবান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার ঘোষণা দেয়। অবশ্য সরকার গঠন করলেও বিশ্বের কোনো দেশই এখনও পর্যন্ত তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। এর জেরে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ও এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থাও আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তাসহ অর্থ সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে দেয়।
অধিকাংশ দেশ তালিবান শাসনাধীন আফগানিস্তানকে স্বীকৃতি না দিলেও তারা বারবার মানবধিকার ও নারী অধিকারের বিষয়টি তুলেছে। তাদের অন্যতম দাবি ছিল, মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তালিবান সরকারের স্বীকৃতি এবং আফগানিস্তানকে ত্রাণসাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রেও নারী অধিকার ও শিক্ষার বিষয়টি তারা সামনে এনেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তালিবানের আফগান দখলের পর থেকেই দেশটিতে নারীদের অবস্থান নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে। অত্যাচার নিপীড়নের পাশাপাশি বাড়ি থেকে কম বয়সী নারীদের জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া এমনকি মৃতদের ধর্ষণের অভিযোগও উঠেছে তালিবানের বিরুদ্ধে। আফগানিস্তানে নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রা থমকে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। কর্মজীবী নারীদের উপর নেমে আসছে নিয়মের খড়গ।
আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পর গত কয়েক মাসে পুরো পাল্টে গেছে দেশটির চেহারা। এরই মধ্যে আফগান নারী ও পুরুষের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। নারীরা বাড়ির বাইরে গেলে অবশ্যই তাদের বোরকা পরতে হবে। এ ছাড়া এ সময় তাদের সঙ্গে অবশ্যই একজন পুরুষ থাকতে হবে। ফলে নারীদের বাইরে চলাফেরা কঠিন হয়ে পড়েছে। ভয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন নারীরা।
তালিবান শরিয়া মোতাবেক নারী স্বাধীনতা দেওয়ার ঘোষণা দিলেও আফগান নারীদের আতঙ্ক কাটেনি। তারা বলছেন, তালিবানের অতীত শাসনে যেভাবে নারীদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় তারা।
আফগান নারী ও মেয়ে শিশুদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভাঙায় তালিবানের কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস।
অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘আফগান নারী ও মেয়ে শিশুদের দেওয়া তালিবানের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হতে দেখে আমি বিশেষ শঙ্কিত। আমি জোরালোভাবে তালিবানকে নারী ও মেয়ে শিশুদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং মানবিক আইনের বাধ্যবাধকতা মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছি।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২২৩৩
আপনার মতামত জানানঃ