নজিরবিহীন চাপের মুখে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। প্রধানন্ত্রীর কার্যালয় ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের প্রধানের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন তিনি। তবে দলের নতুন নেতা বেছে নেওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এখবর জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৭ জুলাই) বিকেলে ডাউনিং স্ট্রিটের দরজার সামনে সংক্ষিপ্ত ঘোষণায় বরিস বলেন, ‘নতুন নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া এখন থেকেই শুরু হওয়া উচিত। আজ আমি একটি মন্ত্রিসভা নিয়োগ দিয়েছি। একজন নতুন নেতা নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি দায়িত্ব পালন করবো’।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স তাদের খবরে জানায়, আইনপ্রণেতাদের চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার ঘোষণা দেন বরিস জনসন।
বরিস জনসনের পতন যে ঘনিয়ে এসেছে তা অনেকদিন আগে থেকেই অনুমিত হচ্ছিল। মাস খানেক আগে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে নিজের পদের জন্য আস্থা ভোট সংগ্রহ করতে হয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যে পদত্যাগ করেন ট্রেজারি প্রধান ঋষি সুনক এবং স্বাস্থ্য সচিব সাজিদ জাভিদ। পদত্যাগ করেন সদ্য নিযুক্ত শিক্ষামন্ত্রীও।
এরপরেই বিষয়টি আরও ঘোরালো হয়ে যায়। আজ বৃহস্পতিবার তা একদম স্পষ্ট হয়ে গেল। জনসন নিজেই জানিয়ে দিলেন যে তিনি পদত্যাগ করতে রাজি।
আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বরিসের ভবিষ্যৎ ঘোর অনিশ্চয়তায় পড়েছে। কয়েক মাসের নিরবচ্ছিন্ন রাজনৈতিক অস্থিরতা গত মঙ্গলবার ব্যাপকতর হয়। এদিন মাত্র ১০ মিনিটের ব্যবধানে অর্থমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। একজন কনজারভেটিভ পার্লামেন্ট সদস্যের (এমপি) বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী আমলে না নেওয়ায় ঘটনার সূত্রপাত্র হয়।
এরপর জুনিয়র মন্ত্রী ও এমপিদের পদত্যাগ ও অনাস্থা জানানোর হিড়িক শুরু হয়। গতকাল বুধবার রীতিমতো পদত্যাগের বন্যা বয়ে যায়। চলে গভীর রাত পর্যন্ত। এদিন সন্ধ্যায় জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের একটি দল ডাউনিং স্ট্রিটে যান প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগে রাজি করাতে।
৫০ জনের বেশি মন্ত্রী ৪৮ ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে ব্রিটেন সরকার থেকে পদত্যাগ করেছেন। তারা বলেছেন যে একাধিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত জনসন। এরপরেও তিনি দায়িত্বে থাকার উপযুক্ত নন। তার দল, কনজারভেটিভ পার্টির কয়েক ডজন প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করছেন বলে খবর মিলেছে। এসব চাপের মুখে পড়ে তিনি নিজেই সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এই বছরের অক্টোবরে কনজারভেটিভ পার্টির সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে একজন নতুন নেতা নিযুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত জনসন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকবেন। কয়েকদিন ধরে তার চেয়ার বেশ টলমল করছিল। নিজের গদি বাঁচাবার প্রচুর চেষ্টা করেন। কিন্তু জনসনকে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া সকলেই তার সঙ্গ ছেড়ে চলে যান। ফলে পতন ঘন্টা বেজে যায় তার।
কয়েকদিন ধরে তার চেয়ার বেশ টলমল করছিল। নিজের গদি বাঁচাবার প্রচুর চেষ্টা করেন। কিন্তু জনসনকে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া সকলেই তার সঙ্গ ছেড়ে চলে যান। ফলে পতন ঘন্টা বেজে যায় তার।
কনজারভেটিভ পার্টির সংসদ সদস্য টবিয়াস এলোড প্রথমে জনসনের পদত্যাগের বিষয়টি সামনে আনেন। তিনি বলেন, পার্টির দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন জনসন। এ নিয়ে দলে কোনো মতবিরোধ নেই।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, বরিস জনসন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও সরে দাঁড়াচ্ছেন।
ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্ব চলে গেলে সরকার প্রধানের পদেও থাকা হবে না জনসনের। তবে কনজারভেটিভরা নতুন নেতা ঠিক করার আগ পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব চালিয়ে নেবেন।
জনসন তার পদত্যাগের সিদ্ধান্তের কথা এরইমধ্যে টোরি পার্লামেন্টারি গ্রুপ ১৯২২ কমিটির চেয়ারম্যানকে কাছে জানিয়ে দিয়েছেন বলে জানিয়েছে বিবিসি। অক্টোবরে দলীয় সম্মেলনে দায়িত্ব নেওয়া নতুন নেতাই প্রধানমন্ত্রী পদে জনসনের স্থলাভিষিক্ত হবেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স লিখেছে, দলে বিদ্রোহীদের পাশাপাশি নতুন নিয়োগ পাওয়া মন্ত্রীরাও জনসনকে ছেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিলে তার সরকার অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে পদত্যাগ ছাড়া অন্য কোনো পথ জনসনের জন্য খোলা ছিল না।
গত ৬ জুন বরিস জনসনের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট আয়োজন করেন কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যরা। এ দলটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে একবার কোনো অনাস্থা ভোট আয়োজন করলে, আগামী এক বছরের মধ্যে কোনো এরকম ভোট আয়োজন করা যাবে না।
এ নিয়ম পরিবর্তন করার তোড়জোড়ও শুরু হয়েছিল। তবে এর আগেই পদত্যাগে রাজি হয়েছেন জনসন।
জনসন সম্প্রতি মিত্রহীন হয়ে পড়েছিলেন। তার বিশ্বস্ত সবাই তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। তার অর্থমন্ত্রীও পদত্যাগ করেছেন।
জনসন যখন ২০১৯ সালে ক্ষমতায় আসেন, তখন দেখা গিয়েছিল যে, তিনি ব্রিটেনের এমন কিছু অংশে ভোট পেয়েছেন যা আগে কখনও তার কনজারভেটিভ পার্টি পায়নি। তারপরেও রক্ষা হল না। আসলে তার দলের লোকেরাই তাকে চাইছেন না। তার অর্থমন্ত্রী, নাদিম জাহাভি, যিনি শুধুমাত্র বুধবার এই পদে যোগ দিয়েছিলেন, তিনিও জনসনকে পদত্যাগ করার কথা বলেছেন। এর পরপরই, নবনিযুক্ত শিক্ষা সচিব মিশেল ডোনেলান পদত্যাগ করেন, বলেন যে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে সরে যাওয়ার জন্য “অনুরোধ” করেছেন।
২০১৯ সালে তার বিরুদ্ধে যৌন অসদাচরণের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি উঁচু পদ পেয়েছিলেন। ১ জুলাই, ব্রিটেন সরকার দাবি করে যে জনসন পিনচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। কিন্তু একজন মুখপাত্র পরে বলেন যে এটি সম্পূর্ণ সত্য নয় এবং প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ সম্পর্কে জানতেন।
মঙ্গলবার, সাইমন ম্যাকডোনাল্ড, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ব্রিটেনের বিদেশ দফতরের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাও প্রধানমন্ত্রীকে মিথ্যা বলার জন্য অভিযুক্ত করেন।
শীঘ্রই, জনসন এমপি ক্রিস পিনচারের বিরুদ্ধে পূর্বের অসদাচরণের অভিযোগ সম্পর্কে কী জানতেন তা ব্যাখ্যা করার জন্য চাপের মুখে পড়ে যান। সেই শুরু, পরে আরও নানা সমস্যায় জড়িয়ে যান তিনি।যখন ট্রেজারি প্রধান ঋষি সুনক এবং স্বাস্থ্য সচিব সাজিদ জাভিদ সরকার থেকে পদত্যাগ করেন , তখন জনসন স্বীকার করতে বাধ্য হন যে তিনি পিনচারের ঘটনা লুকাতে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩৫
আপনার মতামত জানানঃ