মোঙ্গলরা ইসলাম ও মুসলমানদের বিনাশসাধন ও ক্ষয়ক্ষতি করেছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ও হৃদয়বিদারক ঘটনা। অপরদিকে এই মোঙ্গলরা যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তখন তাদের ইসলামের সেবা ও ইসলাম প্রচার ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। তারা ইসলাম প্রচারেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল।
ইতিহাসের অন্যতম ট্র্যাজিডি হল চেঙ্গীস খানের এক নাতি হালাকু খানের দ্বারা মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু ও রাজধানী বাগদাদ ধ্বংস করার পূর্বেই চেঙ্গীস খানের আরেক নাতি বারাকাত খান ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর ঈমানী তেজ এমনই ছিল যে তিনি ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিলেন।
হালাকু খান যখন বাগদাদ ধ্বংস করেন এবং মুসলিম খলীফা মুস্তা‘ছিম বিল্লাহকে নির্মমভাবে হত্যা করে মুসলিম বিশ্বকে খলিফা শূন্য করে দেন তখন বারাকাত খান এসব ঘটনা শুনে তিনি হালাকু খানকে চরমভাবে তিরষ্কার করেন এবং মুসলমানদের নির্মম পরিণতির প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকারবদ্ধ হন।
ফলে তাতাররা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যায় এবং বারাকাত খানকে কেন্দ্র করে তাতারদের দুটি বাহিনীর মধ্যে ভীষণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। শুধু বারাকাত খান ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তা নয় মুসলমানদের বুকে কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়া হিংস্র হালাকু খানের পুত্রও অলৌকিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করে। এভাবে তাতারদের নেতাদের মধ্যে পাইকারী হারে ও ব্যাপকভাবে ইসলাম গ্রহণের হিড়িক পড়ে গেলে মোঙ্গলদের সাধারণ জনতা ও সৈন্যদের মধ্যেও কেউ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ইসলামে দীক্ষিত হয়।
ইতিহাসবিদগণ উল্লেখ করেছেন, ইসলামের খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) ও ওসমান বিন আফফান (রাঃ)-এর শাসনকালে বিশেষ করে হজরত ওসমান (রাঃ) সর্বপ্রথম ৩০/৩১ হিজরী সনে ইসলাম প্রচারের জন্য চীনের উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিলেন। সেই প্রতিনিধি দল চিনের তৎকালীন শাসক তানেগ পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ দেন। পরবর্তী কালে ৯৪ হিজরী সনে মুসলিম সেনাপতি কুতায়বা ইবনু মুসলিম যখন তৎকালীন চীনের রাজধানী কাশগর জয় করেন তারপর থেকে এশিয়ায় ইসলাম প্রচার হ’তে থাকে। [মুহাম্মাদ ফাৎহুল্লাহ যিয়াদী, যাহিরাত ইনতিশারিল ইসলাম, ২২২-২২৪ পৃঃ।]
এরপরে উমাইয়া শাসক হিশাম বিন আব্দুল মালেক মোঙ্গলদের নিকট ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন। ইয়াকূত আল-হামাবী বলেন, ‘হিশাম বিন আব্দুল মালেক তুর্কী রাজার কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ করেন। দূত বলেন, আমি রাজার দরবারে প্রবেশ করলাম তখন তিনি হাতে বাতি নিয়েছিলেন। তিনি দোভাষীকে জিজ্ঞেস করলেন, ইনি কে? সে বলল, আরবের বাদশাহর দূত। তিনি বললেন, আমার গোলাম? সে বলল, হ্যাঁ। আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হ’ল যেখানে প্রচুর গোশত ও অল্প রুটি ছিল। এরপর আমাকে তলব করা হ’ল। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার লক্ষ্য কী? আমি বিনয় প্রদর্শন করে বললাম, আমার বাদশাহ আপনাকে উপদেশ দিতে চান। তিনি মনে করেন, আপনি ভ্রান্ত পথের উপরে রয়েছেন। তিনি চান যেন আপনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ইসলাম কি? তখন আমি ইসলামের শর্তসমূহ, ফরযিয়াত, হালাল-হারাম সকল বিষয় তুলে ধরলাম। অতঃপর এ অবস্থায় কয়েকদিন অতিবাহিত হ’ল। একদিন তিনি পতাকা ধারী দশজন সৈন্যের সাথে বের হ’লেন। আমাকেও সাথে নেওয়া হ’ল। অবশেষে এক টিলায় গিয়ে পৌঁছলাম। যার চার দিকে জঙ্গল ছিল। সূর্য উদিত হ’লে বাদশাহ তাদের একজনকে পতাকা উত্তোলন করে তা উদ্ভাসিত করার নির্দেশ দিলেন। পতাকা দেখে সেখানে সশস্ত্র দশ হাযার সৈন্য উপস্থিত হ’ল। এরা আবার প্রত্যেকে পতাকা উত্তোলন করে উদ্ভাসিত করল। তা দেখে এক লক্ষ সৈন্য টিলার চারপাশে সমবেত হ’ল। তখন বাদশাহ বললেন, ‘এই দূতকে বলে দাও, সে যেন তার নেতাকে বলে দেয় যে, এদের মধ্যে কোন হাজ্জাম, নাপিত এবং দর্জি নেই। এরা যখন ইসলাম গ্রহণ করবে এবং এর শর্তসমূহ জীবনে বাস্তবায়ন করবে তখন তারা কোথায় রিযিক পাবে? [মু‘জামুল বুলদান ২/২৪, তথ্যসূত্রঃ তাতারদের আদ্যোপান্ত, আব্দুর রহীম]
ড. মুহাম্মাদ আলী আল-বার্র তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, মোগল কবি আহমাদ ইউসাভীর হাতে এক লক্ষ তুর্কি জনগণ ইসলাম গ্রহণ করেন যেমন মোগলদের হাজার হাজার মানুষ তার হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মোগল বংশদ্ভূত এবং কাজাখস্তানের অধিবাসী। তিনি ৫৬২/১১৬৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন যা চেঙ্গীস খানের আবির্ভাবের দু’বছর পূর্বের ঘটনা। [মুহাম্মাদ আলী আল বার্র, কায়ফা আসলামা মোগল ১/৫৫]
তাতাররা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঘটনার সম্মুখীন হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। কেউবা ইসলাম ধর্মের সঠিক মর্ম উপলদ্ধি করে ইসলাম গ্রহণ করেছে। হাদীসের ভাষ্যকার হাফেজ ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহঃ) একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন, ঘটনাটি হলঃ
শায়খ জামালুদ্দীন ইবরাহীম জনসম্মুখে বলেন, আমি হালাকু খান ও তার সন্তান আবাকের অর্থমন্ত্রী সুনজাকের নিকট উপস্থিত ছিলাম। সুনজাক মোঙ্গল থেকে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিল। আমরা তখন তার তাঁবুতে উপস্থিত ছিলাম। তার কাছে একদল মোঙ্গল নেতা ও একদল খৃষ্টান ধর্মযাজকও উপস্থিত ছিল। দিনটা ঘন কুয়াশাপূর্ণ। এক অভিশপ্ত খৃষ্টান হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) নিয়ে কটাক্ষ করে বলল, ‘মুহাম্মাদ (ছাঃ) কিসের দাওয়াত দিতেন। তিনি তো ক্ষুধার্ত মানুষের মাঝে অবস্থান করতেন। তিনি তাদেরকে ধন-সম্পদ দিতেন এবং সে বিষয়ে বিরাগী করতেন। আর এভাবেই তাদেরকে নিজের দলে টেনে নিতেন’। এভাবে নবী হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে সে কটু কথা বলতে থাকে। তাঁদের সম্মুখেই একটি শিকারী কুকুর ছিল। কুকুরটিকে সোনার শিকল দ্বারা বেঁধে রাখা হয়েছিল। এবং কুকুরটি সুনজাকের খুব বিশ্বস্থ ছিল। ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সম্পর্কে খ্রীষ্টান ব্যক্তিটির কটূক্তি ও কটাক্ষ শুনে কুকুরটি দাঁড়িয়ে গেল এবং শিকল ছিঁড়ে সেই অভিশপ্ত খ্রীষ্টানের উপর হামলা করে দিল। কুকুরটি খ্রীষ্ঠান লোকটিকে খামচিয়ে ক্ষতবিক্ষ করে দিল। আশেপাশের লোকজন কুকুরটিকে ধরে আবার শিকলে বেঁধে করল। তখন উপস্থিত জনতার মধ্যে কেউ কেউ বলল, এটা তোমার মুহাম্মাদ (সাঃ) সম্পর্কে বাজে কথা বলার ফল। খ্রীষ্টান লোকটি তাঁদের কথা অস্বীকার করে বলল, “তোমাদের ধারণা সম্পূর্ণভাবে ভুল। বরং কুকুরটি খুবই চালাক। সে আমাকে দেখে বুঝতে পেরে গেছিল যে আমি তাকে মারব। সেজন্য সে আমার উপর হামলা করে। এরপর আবার সেই অভিশপ্ত খ্রীষ্টান নবী হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করা শুরু করে। সেই সময় কুকুরটি আবার শিকল ছিঁড়ে সেই খ্রীষ্টান লোকটির উপর হামলা করে। শেষ পর্যন্ত কুকুরটি সেই অভিশপ্ত খ্রীষ্টান ব্যক্তিটির শাসনালী কামড়ে ছিঁড়ে ফেলে। এতে সে মারা যায়। ঘটনাটি মুখে মুখে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে চল্লিশ হাজারর তাতার ইসলাম গ্রহণ করে। [হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী, আদ-দুরারুল কামিনা ফী আ‘য়ানিল মিয়াতিছ ছামিনা ৪/১৫৩; যাহাবী, মু‘জামুশ শুয়ূখিল কাবীর ২/৫৬-৫৭; শায়খ আবু মু‘আবিয়া বায়রূতী বলেন, ঘটনাটির বর্ণনা সূত্র ছহীহ, আরশীফ মুলতাকা আহলিল হাদীছ ১৪৭/৩৩৫, তথ্যসূত্রঃ তাতারদের আদ্যোপান্ত, আব্দুর রহীম]
বারাকাহ খান প্রথম মোঙ্গল রাষ্ট্রপ্রধান যিনি প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। বারাকাহ খান ছিলেন চেঙ্গীস খানের পুত্র জুজীর সাতটি ছেলের মধ্যে একজন ও দুর্ধর্ষ হালাকু খানের চাচাত ভাই। বারাকাহ খান ইসলাম গ্রহণ করে বাগদাদের খলীফা মুস্তা’ছিম বিল্লাহর হাতে বায়’আত (শিষ্যত্ব) গ্রহণ করেন।
‘তিনি হালাকু’র চাচাত ভাই। এই বারাকাহ খান ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি আলেম-ওলামা ও সৎ ব্যক্তিদের পসন্দ করতেন। তার সর্বাধিক উত্তম কাজ ছিল হালাকু ও তার সৈন্যদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি ও বিভক্তি তৈরি করা। তিনি বাদশাহ যাহের বাইবার্সকে সম্মান ও তার দূতদের সমাদর করতেন। তার পরে তার পরিবারের মানকুতামুর (مَنْكُوتَمُرُ بْنُ طُغَانَ) শাসনভার গ্রহণ করেন যিনি বারাকাহ খানের পদাংক অনুসরণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। ফালিল্লা-হিল হাম্দ’। [আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়া, ১৩/২৪৯]
চেঙ্গীস খানের চার পুত্র ছিল। তাঁদের নাম যথাক্রমে জওজি খান, চুগতাই খান, ওগতাই খান (খাকান উপাধিধারী) এবং তোলাই খান। চেঙ্গীস খানের মৃত্যুর পর তার গোটা সাম্রাজ্য এই চার ভাইয়ের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়।
জওজি খানের পুত্র বাতু খান পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে সাম্রাজ্যের পশ্চিমাংশের অধিপতি হন এবং ‘সিরাদারদা’র খান হিসেবে গণ্য হন। চুগতাই খান মধ্য এলাকার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন।
ওগতাই খান ‘খাকান’ হিসেবে পিতা চেঙ্গীস খানের স্থলাভিষিক্ত হন এবং সাম্রাজ্যের পূর্বাংশ তার মালিকানায় আসে। তার শাসনামল ১২২৯-১২৪১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এ সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, ‘কিরগিজ’ নামক এক ইরানি শাসক প্রথমে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন, পরে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
তোলাই বা তাওয়াল্লি খান, তিনি ইরানের শাসক হন। তিনিই ছিলেন বাগদাদ নগরী ধ্বংসকারী এবং আব্বাসীয় খেলাফতের পতনের মূল কাণ্ডারী কুখ্যাত হালাকু খানের পিতা। ইরানে তিনি ‘ইলখানি’ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন। হালাকু খানের পুত্র তাকুদার তার ভাই বারকাহ খানের স্থলাভিষিক্ত হন এবং তিনি ইলখানি রাষ্ট্রের প্রথম শাসক হিসেবে ইসলাম গ্রহণ করেন।
চেঙ্গীস খানের বড় পুত্র জওজি খানের বংশে সর্বপ্রথম যিনি ইসলাম গ্রহণ করেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়, তার নাম বারকাহ খান অর্থাৎ চেঙ্গীস খানের জ্যেষ্ঠ পুত্রের পক্ষের প্রোপুত্র। অর্থাৎ মোগল শাসকদের মধ্যে ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি।
১২৬২ সালে বারকাহ খান ইসলাম গ্রহণ করেন। প্রথমত, তার সমর্থক অনুসারীরা বিপুল সংখ্যায় পাইকারী হারে ইসলাম গ্রহণ করে। বারকাহ খান আব্বাসীয় খলিফা মুস্তাসিম বিল্লাহকে আমণত্রণ করেন ইসলাম প্রচারের মিশন প্রেরণের জন্য। সুতরাং খলিফার আহ্বানে মোবাল্লেগিন, ব্যবসায়িকবৃন্দ, উলামা এবং ফকিহ (ইসমালী শাস্ত্রবিদ) গণের কয়েকটি দল ইসলামী দেশগুলো থেকে হিজরত করে কেরমে পৌঁছেন এবং সেইসব স্থানে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। সেই এলাকাটি ‘খাজানায়ে আলম’ অর্থাৎ বিশ্বের রত্মভান্ডার নামে বিখ্যাত।
বারকাহ খানের ইসলাম গ্রহণের কাহিনী এক বিচিত্রকর ঘটনা। একদিন বোখারা থেকে একটি দল বারকাহ খানের দরবারে এসে উপস্থিত হয়। দলটিতে দুইজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও যোগ্য আলেমও ছিলেন। বারকাহ খান তাদেরকে একটি নিরিবিলি স্থানে নিয়ে যান এবং একান্ত বৈঠক করেন। বারকাহ খান তাদের কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় জানতে চান। তাঁরা খুব সুন্দরভাবে তাকে ইসলামের নিয়ম নীতি ও তার বাস্তবতা ও সত্যতার কথা অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা বুঝিয়ে দেন। বারকাহ খান ইসলামের কথা শুনে তাতে এতই মুগ্ধ হন যে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান হয়ে যান এবং সাথে সাথে তাঁর ছোট ভাইকেও ইসলাম গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করেন। অতঃপর বারাকাহ খানের ছোট ভাইও সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন।
ইসলাম গ্রহণের পর বর্তমান রাশিয়ার সারাই ও সারাতোভ শহর দু’টি বারাকাহ খান প্রতিষ্ঠা করেন। তখন সারাতোভই ছিল মোগলদের রাজধানী।
বারাকাহ খান মামলূক শাসকদের সাথে এক সুদৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন এবং তিনি মামলূক শাসক রুকনুদ্দীন যাহের বাইবার্সের সাথে নিয়মিত পত্র আদান-প্রদান করতেন। মামলুক শাসক বাইবার্স বারাকাহ খানকে তারই চাচাত ভাই ও ইসলামের জঘন্যতম শত্রু হালাকু খানকে হত্যা করতে উৎসাহিত করেন। তিনি বারাকার খানকে উপদেশ দিয়ে বলেন, “ইসলাম তার শত্রুদের হত্যা করাকে আবশ্যক করে যদিও শত্রু আত্মীয়-স্বজন বা পরিবারের সদস্য হয়।”
বাস্তবেও বারাকাহ খান বাইবার্সকে সহযোগিতা করেছিলেন এবং হালাকু খানকে হত্যার জন্য এবং ইসলামী খেলাফত ধ্বংসের প্রতিশোধ নেবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেন। সেজন্য তিনি হালাকু খানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
হালাকু খান ৬৬৩ হিজরীতে মৃগী রোগে আক্রান্ত হয়ে মারাগা শহরে মৃত্যুবরণ করে। হালাকু খানের পতনের আগে থেকেই তাতারীদের মধ্যে যে ইসলাম গ্রহণের হিড়িক পড়ে গেছিল তা অব্যাহত থাকে। তাতারীদের মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী ব্যাক্তি কুরজুয ইসলাম গ্রহণ করেন। বারাকাহ খান ইসলাম গ্রহণ করলে তিনিও তাঁর সাথে ইসলামে দীক্ষিত হন। কুরজুযের অধিকাংশ সৈন্যরাও ইসলাম গ্রহণ করে। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, কুরজুযের সকল সৈন্যই ইসলামে দীক্ষিত হয়ে গিয়েছিল। তার ইসলাম গ্রহণই মিসরের সুলতান বায়বার্সের সাথে বারাকাহ খানের সুসম্পর্ক সুদৃঢ় করে। ১২৪২ খৃষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। [ড. মাহমূদ সাইয়েদ দাগীম, আত-তাতার ওয়াল মোগল, পৃঃ ১৫০-১৫৪; Paul Ratchnevsky, Thomas Nivison Haining, Genghis Khan: his life and legacy, p. 204,৩৩৮; The Cambridge history of Iran, Vol 5, By University of Cambridge, p. 204.]
মোঙ্গল ইতিহাসে সব থেকে আশ্চর্যজনক ঘটনা হল ইসলামের চরম শত্রু হালাকু খানের পুত্রের তাকুদার খানের ইসলাম গ্রহণ। তাকুদার খান হালাকু খানের সপ্তম পুত্র ছিলেন। হালাকু খান যখন ইরাক, ইরান ও সিরিয়া প্রভৃতি একটার পর একটা মুসলিম রাষ্ট্র ধ্বংস করে যাচ্ছিল সেই সময় তাকুদার খান চীনে অবস্থান করছিলেন।
হালাকু খানের স্ত্রী ছিলেন গোঁড়া খৃষ্টান সেজন্য পুত্র তাকুদার খান মায়ের আদর্শে খৃষ্টীয় আচার আচরণে বড় হয়ে উঠে। তাকুদার খান ক্ষমতায় আরোহণ করলে ৬৮০/৬৮১ হিজরী সনে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণ করে তিনি আহমাদ বিন হালাকু (হালাকুর পুত্র আহমাদ) নাম ধারণ করেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, হালাকু খানের পুত্র আহমাদ তাকুদার খান একাকী ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাঁর অনুসারী বা তাতারদের তেমন কোন লোককে ইসলাম গ্রহণ করাতে সক্ষম হননি। ফলে তার নিকটতম ব্যক্তিরাই তাকে ৬৮৩ হিজরী সনে হত্যা করে। [যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ৫১/১৩৯-১৪০; ইবনুল ইবারী, তারীখু মুখতাছারিদ দুয়াল ১/২৮৯; তারীখুল খামীস ২/৩৮০; আবুল ফিদা, মুখতাছারু ফী আখবারিল বাশার ৪/১৬; আত-তাতার ওয়াল মুগোল, পৃঃ ১৫০-১৫৪]
মোঙ্গলদের আর এক অন্যমত প্রভাবশালী শাসক মাহমূদ কাযানও (১২৭১-১১ মে ১৩০৪) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ইলাখানাতের সপ্তম শাসক। তিনি আরগুন ও কুতলুক খাতুনের সন্তান এবং চেঙ্গীস খানের বংশধর ছিলেন। ইলাখানদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বিখ্যাত ও প্রভাবশালী শাসক ছিলেন। তিনি ১২৯৫/৬৯৩ হিঃ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন। একবছর পর ৬৯৪ হিজরী সনে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
এইভাবে ধীরে ধীরে ইসলামের শত্রু তাতারীরা ধ্বংস হয়ে যায় এবং তাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী প্রজন্মের তাতারীরা অর্থাৎ মোঙ্গলরা ইসলামে দীক্ষিত হয়ে পুরোপুরিভাবে ইসলামের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়।
এসডব্লিউ/এসএস/২১০০
আপনার মতামত জানানঃ