কাজী ফয়সাল : ১৯৮৯ সালে জঙ্গি সংগঠন মুসলিম মিল্লাত বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে পুলিশসহ নিহত হন ২১ জন। এরপর কেটে গেছে ৩১ বছর, রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিবর্তিত হয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু দেশের প্রথম জঙ্গি হামলায় জড়িতদের বিচার নিশ্চিত করা যায় নি এখনও। মামলার আসামিদের হাইকোর্টে রিটের পরিপ্রেক্ষিতে স্থগিত হয়ে যায় বিচারকাজ। মামলাগুলো উচ্চ আদালতের নির্দেশে এখনও স্থগিত রয়েছে। কিশোরগঞ্জের তৎকালীন পুলিশ সুপার নুরুল আনোয়ার বলেন, “মূলত ওটাই ছিল দেশের প্রথম ভয়ঙ্কর জঙ্গী হামলা। অথচ একত্রিশ বছরেও এই মামলার নিষ্পত্তি ঘটেনি। মামলার মূল আসামি ‘মুসলিম মিল্লাতের’ প্রতিষ্ঠাতা কথিত পীর মতিউর রহমান আজ বেঁচে নেই। কিন্তু মামলাগুলো তিন দশক ধরে ঝুলে আছে উচ্চ আদালতে। আর কতকাল ঝুলে থাকবে সেটা আল্লাহই ভাল জানেন।“
দেশের প্রথম জঙ্গি সংগঠন মুসলিম মিল্লাত বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা মেজর পীর মতিউর রহমান ওরফে হামিদ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পদাধিকারী ছিলেন এবং ১১ নং সেক্টরে হামিদ কোম্পানি নামে একটি মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে তিনি মেজর হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন। নিজের প্রতিষ্ঠিত শাপলা হাউজিং সোসাইটির প্রায় ৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মেজর পীর খ্যাত মতিউর রহমান বহিষ্কৃত হন এবং জেলে প্রেরিত হন। সাজা শেষে তিনি চলে যান মধ্যপ্রাচ্যে।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে ১৯৮৬ নিজ এলাকা কিশোরগঞ্জের শিমুলিয়ার পাকুন্দিয়া গ্রামে ফিরে গড়ে তোলেন দেশের প্রথম জঙ্গি সংগঠন “মুসলিম মিল্লাত বাহিনী”। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করেছিলেন সদস্য যাদের অনেকেই ইতিপূর্বেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। ৫ একর জমির ওপর তৈরি করেন ১১৩ টি ঘর, ৬১ টি পরিখা আর শিমুলিয়া ফরজে আইন মাদ্রাসা। এই মাদ্রাসার ছাত্র সংখ্যা ছিল তিন শতাধিক। ছাত্রদের সবাই ছিল কুমিল্লা, যশোর, ঝিনাইদহ, চাঁদপুর, মাগুরা, কুষ্টিয়া ও নারায়ণগঞ্জ এলাকার। ২০ বছরের মধ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয় যুদ্ধবিদ্যা প্রশিক্ষন। গ্রামীণ মানুষের সরলতা এবং ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে এলাকায় নিজেদের জনপ্রিয়তার প্রসার ঘটায়। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের আড়ালে চালিয়ে যাচ্ছিলো সংগঠনকে শক্তিশালী করার প্রক্রিয়া। এক পর্যায়ে এলাকা শরিয়াহ আইন মোতাবেক পরিচালিত হবে বলে ঘোষণা করে সংগঠনটি। শরিয়াহ অনুযায়ী কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের চার ভাগের এক ভাগ তাদের কোষাগারে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। অন্যথায় গর্দান ফেলে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। এতে এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মধ্যেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতি ভয়াবহ হুমকি হিসেবে নিজেদের উপস্থিত করেছিলো।
১৯৮৯ সালের ১২ ডিসেম্বর পুলিশের পাঁচ শতাধিক সদস্য মুসলিম মিল্লাত বাহিনীর আস্তানা ঘিরে ফেলে ফেলে। শুরু হয় দুই পক্ষের গুলিবর্ষণ, যার স্থায়িত্ব ছিল তিনদিন। সংঘর্ষে দুই পুলিশ সদস্যসহ মোট ২১ জন নিহত এবং ২০ জন আহত হয়। কোণঠাসা হয়ে পালানোর সময় ৪৮ জন সশস্ত্র সদস্যসহ ধরা পড়েন গুলিবিদ্ধ মেজর পীর মতিউর রহমান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আসার আগেই এলাকা জুড়ে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে ৮ শতাধিক বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ৩ শতাধিক পরিবার বাস্তুহারা হয়ে পড়ে। ঘটনা পরিদর্শনে এসে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন তৎকালীন সামরিক শাসক এবং রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। বিচার বিভাগীয় তদন্তে পুলিশ প্রশাসন এবং জেলা জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দের প্রত্যক্ষ ভুমিকার সত্যতা মিলেছে। এছাড়াও ২০০৩ সালে বিএনপি সরকারের আমলে মিল্লাত বাহিনিকে জঙ্গি সংগঠন উল্লেখ করার দায়ে অভিযানে বীরত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করা এসপি নুরুল আনোয়ারসহ আরও অনেক পুলিশ সদস্যকে বহিস্কার করা হয়।
সরকারসমূহের জঙ্গি সংগঠনগুলোকে গোপনে রাজনৈতিক সহায়তা দান এবং বিচার প্রক্রিয়াকে বাধগ্রস্থ করায় এ ধরনের সংগঠন এবং তাদের অপকর্মের মাত্রা পরবর্তীতে আরও ভয়াবহ আকার নিয়েছে।
এই ঘটনায় নাম জানা ৯১ জন এবং অজ্ঞাত প্রায় চারশো জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ, হত্যা, লুণ্ঠন, অস্ত্র ছিনতাই ও ত্রাস সৃষ্টির অভিযোগ এনে ৫টি মামলা করা হয়। পরবর্তীতে জামিনে মুক্তি পেয়ে মূলহোতা মতিউর রহমান অন্তর্ধানে চলে যান। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাগালের বাইরে চলে যায় তার গতিবিধি। এরকম একজন দুর্ধর্ষ জঙ্গি সংগঠকের জামিন পাওয়া এবং গতিবিধি নজরে না রাখা দেশের বিচার ব্যবস্থা ও পুলিশ প্রশাসনের কার্যক্রমের যৌক্তিকতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আপনার মতামত জানানঃ