‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ বিশ্বের প্রথম বেনিফিট কনসার্ট। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য এটির আয়োজন করা হয়েছিল। কনসার্টটির আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পুরো বিশ্বে একটি সচেতনতা সৃষ্টি করা। দুটি উদ্দেশ্যেই পূরণ হয়েছিল।
বঙ্গদর্শনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই কনসার্ট থেকে অর্জিত অর্থ দুই লাখ ৪৩হাজার ৪১৮ ডলার ৫০ সেন্টের একটি চেকের এক অংশে লেখা ছিলো ‘বাংলাদেশের শরণার্থী শিশুদের ত্রাণের জন্য’। এছাড়াও ‘ক্যাপিটাল রেকর্ডস’ কনসার্ট ফর বাংলাদেশ লাইভ অ্যালবামের আগাম বিক্রি বাবদ ৩৭ লাখ ৫০হাজার ডলারের আরেকটি চেক দিয়েছিল অ্যাপলকে। পরে অ্যালবাম বিক্রি থেকে আরো অর্থ আসে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকার কর ছাড় দিতে অস্বীকার করে। কারণ সেই কনসার্ট যে দাতব্য উদ্দেশ্য করা হয়েছে-তা নিবন্ধন করা ছিল না। ফলে অর্জিত টাকার বড় একটি অংশ ইন্টারনাল রেভিনিউ সার্ভিসের অ্যাকাউন্টে পড়ে থাকে।
কনসার্টের শুরুতেই বাংলাদেশের পল্লিগীতির সুরের ভিত্তিতে ‘বাংলা ধুন’-নতুন সুর সৃষ্টি করেছিলেন পণ্ডিত রবিশংকর। সেটি দিয়েই আলী আকবরের সঙ্গে যুগলবন্দীতে কনসার্ট শুরু হয়েছিল। তবলায় ছিলেন ওস্তাদ আল্লা রাখা এবং তানপুরায় ছিলেন কমলা চক্রবর্তী।
শুরুতেই পণ্ডিত রবিশংকর এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, ‘প্রথম ভাগে ভারতীয় সংগীত থাকবে। এর জন্য কিছু মনোনিবেশ দরকার। পরে আপনারা প্রিয় শিল্পীদের গান শুনবেন। আমাদের বাদন শুধুই সুর নয়, এতে বাণী আছে। আমরা শিল্পী, রাজনীতিক নই। বাংলাদেশে অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। ’
এভাবে তিনি বাংলাদেশের প্রতি মনোযোগ তৈরি করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। শুরু করেছিলেন রবিশংকর আর শেষ করেছিলেন জর্জ হ্যারিসন।
জর্জ হ্যারিসন আটটি গান গেয়েছিলেন। এর একটি ছিল বব ডিলানের সঙ্গে। বব ডিলান গেয়েছিলেন পাঁচটি গান। এই কনসার্টের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন বব ডিলান ও জর্জ হ্যারিসন। এরিক ক্ল্যাপটন গিটার বাজিয়েছিলেন। রিঙ্গো স্টার ও বিলি প্রেস্টন একটি করে গান করেছিলেন। লিওন রাসেল একটি একক এবং ডন প্রেস্টনের সঙ্গে একটি গান করেছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষ পরিবেশনা ছিল জর্জ হ্যারিসনের সেই অবিস্মরণীয় গান ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’।
প্রথমে পরিকল্পনা ছিল, একটি কনসার্ট হবে। কিন্তু সেদিন এত বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল কনসার্টটি যে পরে অনুষ্ঠানসূচি ঠিক রেখে, একই দিনে আরও একটি অনুষ্ঠান করতে হয়েছিল দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এর।
পণ্ডিত রবিশংকরের উদ্দেশ্য ছিলো ২৫-৩০ হাজার ডলার সংগ্রহ করে শরণার্থীদের সাহায্য করা। হ্যারিসন ভাবছিলেন অন্য কথা। রবিশংকরের প্রস্তাবটা লুফে নিলেন, তবে তার মাথায় এলো অন্য চিন্তা। বিটলসের একজন সদস্য হিসেবে নিজের তারকামান ও বাজারদর চিন্তা করে এই আত্মবিশ্বাস জন্মালো যে কমপক্ষে এক মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা খুবই সম্ভব।
হ্যারিসনের স্ত্রী অলিভিয়ার বরাত দিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক মতিউর রহমান লিখেছেন , “তারপর থেকেই জর্জ কনসার্টের জন্য বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল ও অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বব ডিলান আর এরিক ক্ল্যাপটন অনুষ্ঠানের একদিন আগে নিউইয়র্কে এসে উপস্থিত হন। আর ‘ইমাজিন’ গানের অমর শিল্পী জন লেনন অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ আগে তাঁর অপারগতার কথা জানান জর্জকে”।
সত্তরের দশক থেকেই পুরো বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিলো। যুক্তরাষ্ট্র তখন ছিলো পাকিস্তানের পক্ষে। সেই যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতেই অনুষ্ঠিত দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ যেমন বাঙালির স্মৃতিতে অবিস্মরণীয় তেমনি জর্জ হ্যারিসনও।
এসডব্লিউ/এসএস/২১০৭
আপনার মতামত জানানঃ