রাজনৈতিক চাপ আমলে না নিলেও অনাকাঙ্ক্ষিত নানা ঘটনায় চাপে পড়েছে সরকার। নতুন নুতন ইস্যু নিয়ে সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। একটি ইস্যু শেষ হতে না হতেই নতুন আরেকটি ইস্যুর মুখে পড়তে দেখা যায় সরকারকে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে সম্প্রতি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এই নিষেধাজ্ঞা জারির পর নতুন করে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। র্যাব-এর ওপর দেয়া নিষেধাজ্ঞাকে প্রত্যাহার করাতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে কূটনৈতিক চ্যানেলে চিঠি চালাচালিসহ দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে ঢাকাকে। এসব বিষয়ে শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিব্রতকর পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে সরকারকে। তবে ক্ষমতাসীন দলের সিনিয়র নেতারা মনে করেন, এসব ইস্যু আর কিছু নয়, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বিরোধী দলগুলো দেশ-বিদেশে নানা ষড়যন্ত্র করছেন।
এ ছাড়া গত বছরে বেশ কয়েকটি ঘটনার জন্য সরকার বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে সময় পার করেছে। তার মধ্যে অন্যতম হল—মেয়র জাহাঙ্গীরকে মেয়র পদ থেকে বহিষ্কার, সাংবাদিক রোজিনাকে হেনস্তা ও গ্রেফতার ও প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদের নানা কর্মকাণ্ড। এসব ইস্যুতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা চালিয়েছে। এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকালে ইসলামিক দলগুলো ও ছাত্র অধিকার পরিষদসহ সমমনা কয়েকটি ডানপন্থি দল তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। তাদের মারমুখী কর্মসূচি ঠেকাতে পুলিশের সঙ্গে একাধিক জায়গায় সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন নিহতও হয়। এই নিয়েও বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয় সরকারকে। এছাড়া ডিজিটাল আইন, রাজনৈতিক হত্যা এসব তো আছেই। এখন প্রশ্ন এইসব কলঙ্ক কি পদ্মা সেতু মেটাতে পারবে?
আগামী জাতীয় নির্বাচনের বাকি এখনও প্রায় দেড় বছর। এরই মধ্যে উত্তাপ বাড়তে শুরু করেছে রাজপথে। ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাকযুদ্ধ শুরু হয়েছে আগেই। সম্প্রতি বিরোধী দলগুলো নিজেদের ঐক্য সুদৃঢ় করতে মাঠে নেমেছে। এমন পরিস্থিতিতে পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের ট্রামকার্ড হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে গিয়েছিল, তখন এর নির্মাণ নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে সমালোচনার মুখে যেমন পড়েছিল, একইসাথে এই সেতু নির্মাণের প্রশ্নে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছিল। তবে দাতাদের অর্থায়ন ছাড়াই পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার তা বাস্তবায়ন করেছে।
সে কারণেই দেশের সবচেয়ে বড় এবং ব্যয়বহুল স্থাপনা পদ্মা সেতু রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। সেই পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হচ্ছে আজ (শনিবার)। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই পদ্মা সেতু নির্মাণকে তাদের রাজনৈতিক সাফল্য হিসাবে তুলে ধরছে।
কিন্তু দলটি তাতে রাজনৈতিকভাবে কতটা লাভবান হবে-এমন প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই সেতু নির্মাণকে তাদের রাজনৈতিক সাফল্য হিসাবে তুলে ধরছে। দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, তাদের দলের সরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েই অর্থায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সেতু নির্মাণ করেছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগে এবং শেখ হাসিনার সরকারের বিশাল এক রাজনৈতিক সাফল্য। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে। এই সময়ে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বা বড় বড় প্রকল্প নেয়া হয়। নির্বাচনের আগের বছর সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু চালু করা হচ্ছে।
লেখক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, লম্বা সময় ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণে দল এবং সরকার একীভূত হয়ে গেছে। সেকারণে সরকারের কর্মকাণ্ডকে দলীয় অর্জন হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, আওয়ামী লীগ নিস্ক্রিয় একটা দলে পরিণত হয়েছে। এখন সরকারের সমর্থনেই দলটি চলছে। অর্থাৎ সরকার এবং দলের পার্থক্য ভুলে দলটি সরকারে একীভূত হয়ে গেছে। সেজন্য আওয়ামী লীগকে আলাদাভাবে তুলে ধরার জন্য পদ্মা সেতুর সাফল্যকে দলীয় অর্জন হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
একইসাথে মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার যদি পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ ঠিকমত করতে না পারতো, তাহলে কিন্তু এটা নিয়ে বিরোধী রাজনীতি অনেক সরগরম হতো।
নাগরিক অধিকার আন্দোলনকারী খুশী কবির বিষয়টা দেখেন ভিন্নভাবে। তিনি মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার কারণেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে। সেই কৃতিত্ব রাজনৈতিকভাবেও দলটি নিতে পারে।
কিন্তু গণতন্ত্র, মানবাধিকার সহ মানুষের অধিকারের বিভিন্ন ইস্যুতে যেসব প্রশ্ন রয়েছে তাতে এসব উন্নয়নের বিষয় আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে কতটা ফল দেবে-সেই সন্দেহ তার রয়েছে।
“উন্নয়ন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মানুষের নিরাপত্তা এবং গণতন্ত্রের বিষয়েও গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।”
এদিকে, ডাকসু’র সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরের নেতৃত্বাধীন নতুন দল বাংলাদেশ গণ অধিকার পরিষদও পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়েছে।
নুরুল হক নূর বলেছেন, পদ্মা সেতু জনগণের অর্থে নির্মাণ করা হয়েছে এবং এটি দেশের সম্পদ বলে তারা মনে করেন। সেজন্য তারা এই বড় প্রকল্পের কাজ শেষ করায় তারা ভিন্নমতের হলেও সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
কিন্তু এরপরও তিনি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেলেও তাতে অংশ নিচ্ছেন না। এই অবস্থানের ব্যাপারে নুরুল হক নূরের বক্তব্য হচ্ছে, “সরকার দেশের ভেতরে এবং বিদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে নানামুখী চাপে রয়েছে।সেই প্রেক্ষাপটে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে শোডাউন বা আওয়ামী লীগের প্রচারণায় অংশীদার হওয়া যায় না।”
তবে আওয়মী লীগের নেতারা বলেছেন, পদ্মা সেতু যে তাদের দল এবং সরকারের একটা সাফল্য, সেটা মানুষ আস্থায় নিচ্ছে বলে তারা বিশ্বাস করেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩২৫
আপনার মতামত জানানঃ